একটি গোরস্তান,
কত যে কবর আছে,
ঐ অন্ধকারের কাছে!
বাঁধাই করা,
বাঁধাই ছাড়া,
উপেক্ষিত,
এপিটাফ সহ,
হয়তো কবিতা লেখা!
আঁধার রাতে কবর ঘুরি,
আর মনের কোণে?
কবর খুঁড়ি?
মৃত্যুর এক চোরা স্রোত আসে,
যেন কাঁধ ছুঁয়ে যায় এক হিম হাত!
আমি কাঁপি,
যেন মাঘের শীতে কাবু এক বাঘ!
মরতেই হবে,
আজ,
কিংবা কাল।
তবু কেন হানাহানি?
এত সম্পদ!
অথবা মনের রাণী,
কেউ যাবে না কো সাথে
ঐ আঁধারের গুহায়!
মৃত্যুর সাথে হবে সব চূর-মার,
রয়ে যাবে শুধু শতখানি হাড়,
তাও ক্ষয়ে যাবে সময়ের সাথে।
তবে ফল রয়ে যাবে সময়ের পাতে।
করেছো কি কোন ভালো,
যা অন্যকে দেবে আলো?
ভাবি, শুধু ভাবি,
ভেবে ভেবে হয়রান,
সময়ের সাথে মৃত্যু করবে পান
এই দেহখানি!
ঘনিয়ে আসে গাঢ় অন্ধকার,
আমি ডুবে চলি!
অনেক দিন ধরেই নতুন কোন দুঃসাহসিকতার স্পর্ধা সঞ্চয় করে উঠতে পারিনি। আজ
হঠাৎ করেই যেন এক ঝিলিক সাহস ফিরে পেলাম। খুবই পছন্দের একটা কবিতা নিয়ে
বসে পড়লাম, ওটার অনুবাদ করবো বলে। আমি বরাবরই ইংরেজি ভাষাতে ভীষণ দুর্বল,
তাই এরকমভাবে অনুবাদে হাত দেওয়াটাকে আমার জন্য এক দুঃসাহসিকতা তা বলাই
যায়। এই ব্লগে বেশ কিছুদিন আগে পো এর 'অ্যানাবেল লী' এর অনুবাদ করেছিলাম। অল্প পাঠকের উৎসাহে টের পেয়েছিলাম যে ওবার উৎড়েই গিয়েছিলাম। এবার হাতে নিয়েছি ইয়েটসের 'The Rose in the Deeps of his Heart' - এ। উৎড়াতে পারবো কী না তা আমি জানি না, সে ভার আপনাদের হাতে। আমি চেষ্টা করে গেলাম মাত্র।
হৃদয় কোণে একটি গোলাপ ফুল!
এই চারপাশ ঘেরা ভাঙা-চোরা-খোঁড়া,
উফ্ কী যন্ত্রণা!
এই চারপাশ ঘেরা শত পুরোনোতে, আর ছেঁড়া-ফাটা।
পথটার পাশ থেকে কান্নার আওয়াজ পাই,
কাঁদে এক শিশু।
ঘোড়াবাহী ভারী গাড়ি আগায় অনেক ধীরে --
ক্যাঁচক্যাঁচ করে।
আর কোন এক চাষাঃ
যে যায় এগিয়ে পথে, ভারী ভারী পায়ে।
যায় ছড়িয়ে এ হৃদে একটা শীতল পরশ,
হৃদয়ে আঘাত করে তোমার মধুর স্মৃতি --
গোলাপ হয়ে ফুঁটেছে বুকের গভীর কোণে।
কদাকার সব ভুল,
দারুন করে বলাটা আরেক বিশাল ভুল!
খিদের জ্বালায় মরি আবার গড়ার আশে।
দূরের এক পাহাড়ে, নতুন সবুজ ঘাসে,
এই বসুধার সাথে, ওই আকাশের মাঝে,
কিংবা জলের ভেতর
গড়েছি স্বর্ণ-আঁকড়!
স্বপ্নের মাঝে তোমার ছবি ফোঁটায় হৃদয় কোণে
একটি গোলাপ ফুল!
মূল লেখাটাঃ
The Rose in the Deeps of his Heart
-- William Butler Yeats
All things uncomely and broken,
All things worn-out and old,
The cry of a child by the roadway,
The creak of a lumbering cart,
The heavy steps of the ploughman,
splashing the wintry mould,
Are wronging your image that blossoms
A rose in the deeps of my heart.
The wrong of unshapely things
Is a wrong too great to be told;
I hunger to build them anew
And sit on a green knoll apart,
With the earth and the sky and the water,
Remade, like a casket of gold
For my dreams of your image that blossoms
A rose in the deeps of my heart.
এর আগে হাইকু নিয়ে একটা পোস্ট দিয়েছিলামঃ জাপানি ছন্দঃ হাইকু।
পোস্টটা অনেকেই পড়েছেন, কেউ কেউ মন্তব্য করে উৎসাহ যুগিয়েছেন। তারই
ধারাবাহিকতায় নিজের হাইকু প্রচেষ্টা নিয়ে পোস্ট দিচ্ছি। হাইকু আকারে ছোট
হলেও বদ্ধস্বর বর্জণ করে লেখাটা খুবই কঠিন। কারণ বাংলা ভাষা ঠিক জাপানি
ভাষাটার মতন না। এ ভাষাতে বদ্ধস্বর শব্দের বাহুল্য বাংলাতে হাইকু লেখাকে
কঠিন করে দিয়েছে। কারো কারো মোরা নিয়ে প্রশ্ন ছিল সেটা নিয়ে শুরুতেই আলোচনা
করবো। এরপর মূল পোস্টে যাবো।
মোরা বা Mora বোঝাতে গেলে আমাকে সেই বাংলা ছন্দেই ফিরে যেতে হবে। কারণ
বাংলা ছন্দে একে ব্যাখ্যা করলেই সবচেয়ে সহজবোধ্য হবে বলে আমার মনে হয়। যদিও
বিশেষ কিছু কারণে বাংলা ছন্দ নিয়ে লেখা বন্ধ করে দিয়েছিলাম কিন্তু আজ
ঘুরেফিরে ওখানেই ফিরতে হচ্ছে। আগে এই নিয়ে আলোচনা হয়েছে এখানে, আজ আরেকটু লেখার চেষ্টা করি।
মোরার সংস্কৃত শব্দ হল মাত্রা, যার থেকে বাংলাতেও এর নাম হয়েছে মাত্রা।
বাংলা কবিতায় একটি স্বর উচ্চারণের নিম্নতম কালকে মাত্রা বলে। যেমন: হ্যাঁ,
না, কি, বান্, ধান্, তৃ, বৃ, দেশ্ ইত্যাদি। বাংলাতে কখনো কখনো শব্দের এই
ক্ষুদ্রতম অংশকে একমাত্রার আবার কখনো কখনো দুই মাত্রার হিসেব করা হয়।
সবক্ষেত্রেই মুক্তস্বরকে একমাত্রা ধরা হয়, কিন্তু বদ্ধ্বস্বরকে কোন কোন
ক্ষেত্রে একমাত্রার, আবার কখনো কখনো দুই মাত্রার ধরা হয়ে থাকে।
অক্ষরবৃত্ত ছন্দঃ
মুক্তস্বর - একমাত্রা।
বদ্ধস্বর - কখনো একমাত্রার, কখনো দুই মাত্রার। শব্দের শুরুতে বা মাঝের
বদ্ধস্বর একমাত্রার কিন্তু শেষে থাকলে দুইমাত্রার হবে। যেমনঃ শ্রাদ্ধ =
শ্রাদ্ + ধো; এখানে শব্দের শুরুতে বদ্ধস্বরটিকে একমাত্রার ধরা হবে কিন্তু
শেষে থাকালে দুমাত্রার ধরা হত। যেমনঃ নির্মল = নির্ + মল্; নির্
একমাত্রার, মল্ দুই মাত্রার।
এবার বলুনতো কালপুরুষ শব্দটি কয় মাত্রার??
কালপুরুষ = কাল্ + পু + রুষ
সাধারণ হিসেবে কাল্ কে একমাত্রার ধরতে হলেও ধরা যাবে না, কারণ কালপুরুষ
একটা শব্দ হলেও কাল্ নিজেই একটা পূর্ণ শব্দের গুণ রাখে, আর সেভাবেই
উচ্চারিত হয়। তাই কাল্ দুইমাত্রার হবে, আর কালপুরুষ ৪ মাত্রার না হয়ে ৫
মাত্রার হবে।
অনেক হল, এবার হাইকুতে ফিরি!
(১)
বাদরো ঝরে
কালো কাকেরো 'পরে,
ভিজে গেলো যে!
(২)
বাদলো মাঝে
ভালোবাসাটা খুঁজি...
কতদূরে সে?
(৩)
ভালোবাসাটা
জলেরি মতো করে
কচু পাতাতে!
(৪)
ক্ষ্যাপাটে হয়ে
সে মেতে ওঠে নাচে
মেঘোলা দিনে!
(৫)
তুমি ও আমি
জলোধারারি মাঝে
মিলে যাবো কি?
বিশেষ দ্রষ্টব্যঃ
জাপানি হাইকুর স্বকীয়তা বজায় রাখবার জন্যই বাদর = বাদরো, বাদল = বাদলো,
মেঘলা = মেঘোলা, জলধারা = জলোধারা উচ্চারণ করতে হবে। মাত্রার হিসেব ঠিক
রাখবার জন্য ধারারই = ধারারি (র্+ই দ্রুত উচ্চারিত হয়ে রি হবে), একইভাবে
জলের
আমি ছন্দ নিয়ে কিছু আলোচনা করে কিছু পোস্ট দিয়েছিলাম। ভেবেছিলাম ধীরে ধীরে
এগিয়ে যাবো। কিন্তু আমার ছন্দ আলোচনা, বিশ্লেষণ অনেকেরই ভালো লাগে নি।
এজন্য তারা আমাকে তাদের নানা মন্তব্যে আমাকে হেয় করবার চেষ্টা করেছে। তাই
ভাবলাম ওদের ইচ্ছেরই প্রতিফলন ঘটুক, ওগুলো নিয়ে আর লিখবো না। তবে ছন্দের যে
গভীর প্রেমে আমি মজেছি তাতে ছন্দ থেকে আমার দূরে থাকাটা হয়তো আর হবে না।
আমি ছন্দ নিয়েই থাকবো তবে অন্যভাবে।
প্রত্যেক সাহিত্যেই কবিতার ছন্দ-প্রকৃতি নিয়ন্ত্রিত হয় ঐ ভাষার দ্বারা,
ভাষার উচ্চারণ বৈশিষ্ট্য দ্বারা। জাপানি ছন্দও এই নীতির ব্যতিক্রম না।
জাপানি ভাষায় স্বরবর্ণ সংখ্যা মাত্র পাঁচটি। এগুলোর সবগুলোই হ্রস্ব। জাপানি
ভাষায় কোন দীর্ঘস্বর কিংবা অই্, উউ্ এর মতন বদ্ধস্বর নেই। জাপানি ভাষায়
কোন ব্যঞ্জনস্বরের উচ্চারণও হসন্ত যুক্ত না, অর্থাৎ সবই মুক্তস্বর, কোন
বদ্ধস্বর নেই। তাই জাপানি সাহিত্যে ছন্দের হিসেবে কোন প্রকার জটিলতাই নেই।
ফলে জাপানি সাহিত্যে ছন্দশাস্ত্রও খুব একটা গড়ে অঠে নি।
জাপানি সাহিত্যে কবিতাগুলো হয়ে থাকে খুবই সরল প্রকৃতির। ছন্দবৈচিত্রতার
দরুন জাপানি ছন্দকে শ্রেণিকরণ করা যায় না, তবে মাত্রার পর্বসংখ্যা অনুযায়ী
জাপানি কবিতাকে মোটামুটি পাঁচটি শ্রেণিতে ভাগ করা যায় - হাইকু, তানকা,
চোকা, সেদোকা এবং ইয়ামো।
হাইকু (একবচনে "হাইকি") একধরনের জাপানি কবিতা যাতে মাত্র তিনটি পঙ্ক্তিতে
যথাক্রমে ৫, ৭ এবং ৫ মোরাসের মোট ১৭ মোরাসের সংক্ষিপ্ত পরিসরে একটি
মুহূর্তে ঘটিত মনের ভাব প্রকাশ করা হয়। সাধারণত একটি ছবি বর্ণনা করার জন্য
হাইকু লেখা হয়ে থাকে। মোরাস ও মাত্রা একই ব্যাপার নয়। কিন্তু ইযোরোপীয়রা
১৭ মাত্রার হিসেবে হাইকু লেখার সূত্রপাত করে। তাদের দেখাদেখি বাংলা ভাষায়
১৭ মাত্রার হাইকু লেখার প্রচলন হয়। মোরাস, দল ও মাত্রা এক-একটি ভাষার
নিজস্ব শ্বাস অনুসারী সংজ্ঞায়িত হয়ে থাকে। সেই অনুযায়ী ১২ মোরাসে ১৭ দল
হয় ইউরোপে ইমেজিস্ট আন্দোলনের পর ১৭ দলের পরিবর্তে আরো বেশী দলের হাইকু
লেখা শুরু হয়েছে। জ্যাক কেরুয়াক প্রমুখ মার্কিন কবিগণ স্বীকার করেছেন যে
মার্কিন উচ্চারণ জাপানি উচ্চারণ হইতে সম্পূর্ণ পৃথক। তাই তারা ১৭ দল ও তিন
বাক্য বন্ধন অস্বীকার করে হাইকু লেখার সূত্রপাত ঘটান।
মাৎসু বাশোর "old pond" বা পুরোনো পুকুর হাইকিটা দেখে নিইঃ
古池や蛙飛込む水の音
ふるいけやかわずとびこむみずのおと
উচ্চারণে একে বিন্যস্ত করলে পাইঃ
fu-ru-i-ke ya (৫)
ka-wa-zu to-bi-ko-mu (৭)
mi-zu no o-to (৫)
ইংরেজি অনুবাদঃ
old pond . . .
a frog leaps in
water’s sound
এর বাংলা রূপটা দাঁড়ায়ঃ
পুরোনো পুকুর
ব্যাঙের লাফ
জলের শব্দ।
এটা আক্ষরিক অনুবাদ, হাইকুর ছন্দ রক্ষা করা হয় নি।। হাইকুর ছন্দে রবি ঠাকুর একে ভাবানুবাদ করে লিখেছেনঃ