বৃহস্পতিবার, ২৩ আগস্ট, ২০১২

২৩ আগস্ট...



আকাশ যন্ত্রণায় ছটফট করছে। কিছুতেই নিজেকে ঘরে আটকে রাখতে পারছে না। আজ ওকে বাইরে যেতেই হবে। আকাশের এক বন্ধু জান্নাত ওকে ফোকে আটকানোর চেষ্টা করে হাল ছেড়ে দিলো।

মা ডাকছে, 'কীরে খোকা ঘরের দরজা বন্ধ করে রেখেছিস কেন?? খাবি না। দশটা বাজে! এখনো নাশ্তা করিস নি!'


আকাশ তার সকল যন্ত্রণাটাকে রাগ রূপে মায়ের উপর ঝেড়ে দিলো, 'আমি বললাম তো খাবো না। আমার কিছু ভালো লাগছে না। আমি খাবো না।'


আকাশ কিছুক্ষণ পর ঘরের মাঝে এটা-ওটা ছোড়াছুড়ি করে ঘর থেকে বেড় হয়ে গেল।


আকাশ রাস্তার পর রাস্তা হেঁটে চলছে। ধানমণ্ডি থেকে কাঁটাবন। কাঁটাবন থেকে পরিবাগ। পরিবাগ থেকে বেইলি রোড। বিক্ষিপ্ত মনে হাঁটছে। আর শূন্য দৃষ্টিতে চারপাশে তাকাচ্ছে। সব কিছুর মাঝে একজনের গন্ধ খুঁজে বেড়াচ্ছে। ভালো লাগা একজনের গন্ধ। সেই চেনা রাস্তায় বুক ভরে বাতাস নিচ্ছে আর তাতে প্রিয় এক মানুষের গন্ধ পাবার চেষ্টা করছে।


বেইলি রোডে ভিকারুন্নেসার সামনে এসে দাঁড়িয়ে গেল। অনেক মেয়ে আর তাদের সাথের লোকজনের ভীড়। প্রত্যেকটা মেয়েকে আকাশের মনে হচ্ছে বয়সে কত ছোট। দশ বছর আগে বৃষ্টিও এই বয়সীই ছিল। নিজেকে সামলে নিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে চললো। ফাস্ট ফুডের দোকানের সামনে আসতেই দেখলো ও আর বৃষ্টির প্রিয় সময় কাটানো 'ইউরো হাট' আর নেই। সেখানে 'সসেজ' নামে নতুন একটা খাবারের দোকান হয়েছে।


আকাশ এগিয়ে চলে। শান্তিনগর মোড় হয়ে হেঁটে চলে সেগুন বাগিচার দিকে। সেগুন বাগিচা হয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে পা বাড়ায়। গন্তব্য শহীদ মিনার।


আকাশ আকাশের দিকে তাকায়। আজ আকাশে কোন মেঘই নেই। কিন্তু দশ বছর আগের দিনটাতে ছিল। আকাশ জোড়া কালো মেঘ ছিল। ছিল ঝুম বর্ষা।


শহীদ মিনারের কাছের সিঁড়িটার দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়। আকাশের থেকে ন-দশ বছরের ছোট ছেলে-মেয়ে বসে আছে। একজন আরেক জনের দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। আকাশের সব মনে পড়ে যায়। ঠিক দশ বছর আগে ঠিক ঐ জায়গাটাতেই বসে ছিল আকাশ আর বৃষ্টি। আর আকাশ থেকে অবিরাম বৃষ্টি ঝড়ছিল। ঐ অঝোড় বৃষ্টিতে ভেজা বৃষ্টির কাঁপা-কাঁপা হাত ধরে বলেছিল, 'বৃষ্টি, আমি তোমাকে ভালোবাসি।' বৃষ্টি আকাশকে ফেরাতে পারে নি। একে অপরের চোখে হারিয়ে গিয়েছিল। আর একজন আরেক জন থেকে কত দূরে। সময়ের ব্যবধান দুজনের মাঝে দেওয়াল গড়ে দিয়েছে যদিও একজন আরেকজনকে এখনো চায় অনেক বেশি।


আকাশ আর নিজেকে সামলাতে পারলো না। যত যাই ঘটে যাক আজ ও বৃষ্টিকে ফোন করেই বসবে, যদিও ও নিজেই বৃষ্টিকে বলেছে যেন বৃষ্টি আর ওকে ফোন না দেয়। আকাশ যেই না হাতে মুঠোফোনটা নিয়েছে, ওটার স্ক্রিণে বৃষ্টির নাম্বারটা দেখা যাচ্ছে। আর তার পাশে লাল রঙের হৃদয় চিহ্ণ। বৃষ্টি ওকে ফোন করছে। আকাশ ফোনটা রিসিভ করতে না করতেই বৃষ্টির কান্নার আওয়াজ শুনতে পেল। বৃষ্টি কান্নাভেজা গলায় বলতে লাগলো, 'আমি আর ফোন না করে পারলাম না। তুমি কেমন আছো??'


দু'জনের কথা চলতে লাগলো। আকাশ হাঁটতে হাঁটতে কথা বলছে। ওর চোখের কোণাটা ভিজে উঠেছে। আর ভাবছে সব বাঁধা উপেক্ষা করে কি আবার এক হবে দু'জনে! হঠাৎ লাইনটা কেটে গেল। বৃষ্টি একের পর এক চেষ্টা করতে লাগলো। কিন্তু প্রত্যেকবারই এক মহিলা কণ্ঠ বলছে, 'এই মুহূর্তে সংযোগ দেওয়া সম্ভব না। অনুগ্রহপূর্বক আবার চেষ্টা করুন!'


বৃষ্টি একের পর এক চেষ্টা করে ব্যর্থ হতে লাগলো। ওর আকাশের প্রতি অনেক অভিমান হল। রাতটা নির্ঘুম কাটলো। রাতে কখনো কাঁদলো, কখনো আকাশকে গাল দিলো, কখনো খাটের পাশে মাথা কুটলো।


সকালে বুঝতে পারলো যে আকাশ আর ওর সাথে যোগাযোগ করবে না। বরাবরের মতন হারিয়ে গেছে। চা বানিয়ে বসলো সোফার উপর। দৈনিক পত্রিকাটা সাথে। পৃষ্ঠাগুলো উল্টে-পাল্টে দেখছে। শেষ পৃষ্ঠার এক কোণে ছাপা হয়েছে একটা ছবি। নীল পাঞ্জাবি পরা রক্তাক্ত এক ছেলের ছবি। পাশে লেখাঃ
...... বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী ছাত্র আকাশ নিহত। বৃষ্টি স্তব্ধ হয়ে গেল। যন্ত্রের মতন করে পড়ে গেল বাকিটাঃ


''গতকাল বিকেলে আকাশ শহীদ মিনারের সামনের রাস্তায় মুঠোফোনে কথা বলতে বলতে হাঁটছিলো। এরকম অবস্থায় গাড়ি চাপা পড়ে...... আকাশের পকেটে একটা চিরকূট পাওয়া যায়, যাতে একটা কবিতা লেখা ছিলঃ


'আছে কার সাহস
করবে আমায় বন্ধ?
আজ আমি পথে পথে রবো
খুঁজবো যে তোর গন্ধ...
তোর গন্ধভরা মাদকতা
পাগল করে মোরে...
সকাল-সন্ধ্যা কাটতো আমার
তোর ভালোবাসা আর আদরে...
আসবি না কাছে??
থাকবি আমার দূরে??
দূরেই থাক্‌, বুঝিস না আর
ভালোবাসি কত তোরে...

২৩ আগস্ট, ২০১১
আকাশ'  ''


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন