



আমি টুকটাক লেখালেখি করি। তবে বেশিরভাগ সময়েই সাহিত্য ঘরানার লেখাগুলো ঠিকমত পরিপক্বতা পায় না। আসলে লেখার গভীরতা বাড়ানোর জন্য অনেক বেশি পড়াশোনা করতে হয়। অন্যের লেখা পড়লে, বিশেষ করে ভালো মানের লেখা পড়লে লেখার গুণ, গভীরতা, ব্যপকতা নিশ্চিতভাবেই বাড়ে যদি পড়া লেখাগুলোর কিয়দংশও বোঝা সম্ভব হয়।
আমি আমার আলসেমির দরুন বই পড়াও ছেড়ে দিয়েছি। নানা ব্যস্ততায় ব্লগ পড়াটাও অনেক কমে গেছে। আজ এক বন্ধুর কাছ থেকে পড়ার জন্য একটা বই নিলাম। রাজনৈতিক ভাবে ওপার বাংলার (রাজনৈতিকভাবে দুই বাংলা যতই আলাদা হোক না কেন আমার মনে দুই বাংলা এখনো অভিন্নসত্তা) লেখকের। সুবোধ সরকারের কবিতার বই। এর আগে আমি কখনো সুবোধ সরকার পড়িনি। আমার বন্ধু, সাবিল কবিতাগুলো থেকে কিছু কবিতা আমাকে আবৃত্তি করে শোনালো। তার থেকে একটা কবিতা আমার মাথায় ঘুরছিলো।
বাসায় ফিরে আরো বেশ ক'বার পড়লাম। আমি বাকরুদ্ধ। এই না হল কবিতা! জীবনে এরকম একটা কবিতা লিখতে পারলে লেখালেখির পুরোটাই স্বার্থক। অনেক বেশি মর্মস্পর্শী সে কবিতা। একজন পুরুষ কবি এক হতভাগ্যা-অসহায়া নারীর করুণ চিত্র ফুটিয়ে তুলেছেন সে কবিতায়। আমি মনে মনে নিজেকে সেই নারীর জায়গায় বসানোর চেষ্টা করলাম। যদিও একজনের পক্ষে আরেকজনের দুঃখের পুরোটা কোনভাবেই বোঝা সম্ভব না, তারপর আমি একজন পুরুষ! এরপরও পড়তে পড়তে আমার চোখের কোণাটা ভিজে গেল।
কবিতাটা আপনাদের জন্য তুলে ধরছিঃ
শাড়ি
- সুবোধ সরকার
বিয়েতে একান্নটা শাড়ি পেয়েছিল মেয়েটা
অষ্টমঙ্গলায় ফিরে এসে আরো ছটা
এতো শাড়ি একসঙ্গে সে জীবনে দেখেনি।
আলমারির প্রথম থাকে সে রাখলো সব নীল শাড়িদের
হালকা নীল একটাকে জড়িয়ে ধরে বলল, তুই আমার আকাশ
দ্বিতীয় থাকে রাখলো সব গোলাপীদের
একটা গোলাপীকে জড়িয়ে সে বলল, তোর নাম অভিমান
তৃতীয় থাকে তিনটা ময়ূর, যেন তিন দিক থেকে ছুটে আসা সুখ
তেজপাতা রঙ যে শাড়িটার, তার নাম দিল বিষাদ।
সারাবছর সে শুধু শাড়ি উপহার পেল
এত শাড়ি কী করে এক জীবনে সে পরবে?
কিন্তু এক বছর যেতে না যেতে ঘটে গেল সেই ঘটনাটা
সব্ধের মুখে মেয়েটি বেরিয়েছিল স্বামীর সঙ্গে, চাইনিজ খেতে
কাপড়ে মুখ বাঁধা তিনিটি ছেলে এসে দাঁড়ালো
স্বামীর তলপেটে ঢুকে গেল বারো ইঞ্চি
ওপর থেকে নীচে। নীচে নেমে ডানদিকে।
পড়ে রইলো খাবার, চিলি ফিশ থেকে তখনো ধোঁয়া উঠছে।
এর নাম রাজনীতি বলেছিল পাড়ার লোকেরা।
বিয়েতে একান্নটা শাড়ি পেয়েছিল মেয়েটা
অষ্টমঙ্গলায় ফিরে এসে আরো ছটা
একদিন দুপুরে, শাশুড়ি ঘুমিয়ে, সমস্ত শাড়ি বের করে
ছ'তলার বারান্দা থেকেউড়িয়ে দিল নীচের পৃথিবীতে।
শাশুড়ি পরিয়ে দিয়েছেন তাঁকে সাদা থান
উনিশ বছরের একটা মেয়ে, সে একা।
কিন্তু এই থানও এক ঝটকায় খুলে নিল তিনজন, পাড়ার মোড়ে
একটি সদ্য নগ্ন বিধবা মেয়ে দৌড়াচ্ছে আর চিৎকার করছে, বাঁচাও
পেছনে তিনজন, সে কি উল্লাশ, নির্বাক পাড়ার লোকেরা।
বিয়েতে একান্নটা শাড়ি পেয়েছিল মেয়েটা।
কবিতাটার ভাষা যতটা সহজ ঠিক ততটাই কঠিন এর বক্তব্য। এর ঘটনাটা কঠিনভাবে বুকের বাম দিকে আঘাত করে। মস্তিষ্কে আঘাত করে, এবং সে আঘাত পৌনঃপুনিকভাবে চলতেই থাকে। আমি সে আঘাত থেকে মুক্তি পাই নি। এলোমেলো ভাবনারা আমাকে আরো কিছুদূর সামনে টেনে নিয়ে গেছে। তাইই তুলে ধরলামঃ
শাড়ি
- দেবাশিস্ মুখার্জি
তিনজন দৌড়াচ্ছে, দৌড়াচ্ছে সেই নারীর পেছনে
যে নারীর সিঁথিতে গতকালও সিঁদুর ছিল
নারীদেহ খেতে অনেক মজা, তাই এ সুযোগ ছাড়বে কেন?
সাদা থান কেড়ে নিয়ে হাত বাড়ায় উলঙ্গ বক্ষে
একে একে রক্তাত করে তোলে সারাটা দেহ
নির্বাক পাড়াবাসীর গোচরেই চলে তিন পাষণ্ডের উপভোগ।
তিনজনের পালাবদলে রাতটা পার হয়না সে মেয়ের
ভোরের আলো ফোঁটার আগেই তার জীবন আলোর অস্ত ঘটে
সকাল বেলা হাজির হয় কর্তব্য পরায়ন পুলিশেরা,
একে ওকে জিজ্ঞাস করে, কে এই নারী, ধর্ষিতা নারী!
নির্বাকেরা নির্বাক রয়ে যায়, পুলিশ লাশ নিয়ে ধায়।
আধখাওয়া লাশটার কাটাছেঁড়া চলে, সবশেষে সেলাই,
এর পর মেয়েটার উলঙ্গ দেহে নতুন কাপড় ওঠে, লাশের সাদা কাপড়
পুলিশ লাশটাকে শাশুড়ির কাছে দিয়ে আসে
কিন্তু সে তো একে দিবেনা জায়গা, এ যে অপয়া নারী
একে একে সব নির্বাকেরা সবাক হয়ে ওঠে, বলে, ঠিক ঠিক
সত্যিই ও অপয়া তাই বিয়ের বছর না পেরুতেই স্বামীকে খেলো,
আর কোন ভালো মেয়েকে কি কেউ এভাবে খায়!
এত শাড়ির মালিক হয়েও একটা শাড়ি জোটে না সে মেয়ের
একটা সাদা থানে চিতায় নিতেও নারাজ বুড়ো শাশুড়ি,
কারণ ওর জন্যই যে ওর খোকা মরেছে!
সরকারি কাপড় গায়ে ইলেক্ট্রিক চিতা জলে গঙ্গার ধারে,
কাপড়ের ছায়ারা এখনো ওড়ে রাতের আধাঁরে।
এর্নেস্তো গেভারা দে লা সের্না - বিশ্বজগতে আধুনিক বিপ্লবের ঝাণ্ডা বাহক। মানুষ তাকে ভালোবেসে ডাকতো 'চে', এর্নেস্তো চে গেভারা নামে। আর্জেন্টিনায় 'চে' নামটির মানে অত্যন্ত প্রিয় মানুষ। মার্কিনীরা তাঁর দেহখানি নিথর করে দিয়েছে ৪২ বছর আগেই। কিন্তু তাঁর আত্মা আজও রয়ে গেছে কোটি মানুষের হৃদয়ে।
আজ থেকে ৮৩ বছর আগে এইদিনে এক শুভক্ষণে জন্মেছিলেন এর্নেস্তো। এই এর্নেস্তোই ভবিষ্যতে বিপ্লবের প্রবাদ পুরুষে পরিণত হত। সারাবিশ্ব জুড়ে ছড়িয়ে যাওয়া পুঁজিবাদের বিষবাষ্পে সাধারণ মানুষ যখন চরমভাবে দারিদ্যে আক্রান্ত, তখন কিছু মানুষ এর প্রতিবাদে মাঠে নামেন। একসময় সেই বিপ্লবীদের পাশে এসে দাঁড়ান এর্নেস্তো। তিনি কখনো বিপ্লবীদের করেছেন উদ্বুদ্ধ, কখনো বা নিজেই অস্ত্র হাতে ঝাঁপিয়ে পরেছেন অত্যাচারীদের বিরুদ্ধে। তার কারণে মার্কিনীদের ঘুম হারাম হয়ে গিয়েছিল। তাই এর্নেস্তোকে মেরে ফেলার জন্য হিংস্র জাল ফেলতে থাকেন। ১৯৬৭ সালে এর্নেস্তো যখন বলিভিয়ার বিপ্লবে যোগ দিতে ছদ্মবেশে দেশটিতে যান, তখন ৭ অক্টোবর সিআই এর লোকেরা তাকে আটক করে আর ৯ অক্টোবর ১৯৬৭ সাল বেলা ১.১০ টায় অমানবিকভাবে হত্যা করে। হত্যা করবার পর তার লাশটাও গুম করে ফেলা হয়। পরে ১৯৯৭ সালে ভ্যালেগ্রান্দের একটি গণ-কবরে চে ও তাঁর সহযোদ্ধাদের দেহাবশেষ আবিষ্কৃত হয়।
যারা মানবতার বুলি আওড়ায়, সেই মার্কিনীরাই যখন বিনা বিচারে কাউকে হত্যা করে তখন কোন মানবাধিকার কমিশন আওয়াজ তোলার সাহস পান না। 'চে' এর ক্ষেত্রেও তাই ঘটেছিল।
'চে' ছিল, আছে থাকবে। 'চে' থাকবে সবার অন্তরে, বিপ্লবী চেতনায়। যতদিন না মানুষের গরিবী না ঘুঁচবে, না ঘুঁচবে পুঁজিবাদ আর সাম্রাজ্যবাদের নামে দরিদ্র্য নিপীড়ন, ততদিন মানুষ এই জাল থেকে বেড়িয়ে আসতে বিপ্লবের পথে পা দিবেই। সেই ১৯৬৭ থেকে আজ অনেক বছর চলে গেছে, বিশ্বও অনেক বদলে গেছে। কিন্তু সেই সাধারণেরা আজও নিপীড়িত। তাই সেই বিপ্লব আজও চলবে তবে নতুন আদলে। সময়ের সাথে সাথে কৌশল বদলাবে কিন্তু সাধারণ মানুষের বিপ্লব টিকে থাকবে। জয় বিপ্লবের জয়।
ও ভাই 'কুমড়ো পটাশ' টা কী জিনিস?? ছবি দেখে বলুন তো চিনেন কিনা??
আমার ছোট বেলার সবচেয়ে কাছে যা ছিলো তার একটা হল গল্প-কবিতা-ছড়ার বই, এর মাঝে হ-য-ব-র-ল'ই বেশি থাকতো। মজার মজার গল্প-ছড়ার ভেতর দিয়ে অনেক বেশি অদ্ভুতুড়ে জিনিসের জন্ম দেওয়া মানুষই জিন্ম দিয়েছেন এই 'কুমড়ো পটাশ' কে। এবার ছড়াটা একটু পড়ে নিঃ
(যদি) কুম্ড়োপটাশ নাচে-
খবরদার এসো না কেউ আস্তাবলের কাছে ;
চাইবে নাকো ডাইনে বাঁয়ে চাইবে নাকো পাছে ;
চার পা তুলে থাকবে ঝুলে হট্টমুলার গাছে !
(যদি) কুম্ড়োপটাশ কাঁদে-
খবরদার! খবরদার! বসবে না কেউ ছাদে ;
উপুড় হয়ে মাচায় শুয়ে লেপ কম্বল কাঁধে ;
বেহাগ সুরে গাইবে খালি 'রাধে কৃষ্ণ রাধে' !
(যদি) কুম্ড়োপটাশ হাসে-
থাকবে খাড়া একটি ঠ্যাঙে রান্নাঘরের পাশে ;
ঝাপ্সা গলায় ফার্সি কবে নিশ্বাসে ফিস্ফাসে ;
তিনটি বেলা উপোস করে থাকবে শুয়ে ঘাসে !
(যদি) কুম্ড়োপটাশ ছোটে-
সবাই যেন তড়বড়িয়ে জানলা বেয়ে ওঠে ;
হুঁকোর জলে আলতা গুলে লাগায় গালে ঠোঁটে ;
ভুলেও যেন আকাশ পানে তাকায় নাকো মোটে !
(যদি) কুম্ড়োপটাশ ডাকে-
সবাই যেন শাম্লা এঁটে গামলা চড়ে থাকে ;
ছেঁচকি শাকের ঘণ্ট বেটে মাথায় মলম মাখে ;
শক্ত ইঁটের তপ্ত ঝামা ঘষতে থাকে নাকে !
তুচ্ছ ভেবে এ-সব কথা করছে যারা হেলা,
কুম্ড়োপটাশ জানতে পেলে বুঝবে তখন ঠেলা ।
দেখবে তখন কোন্ কথাটি কেমন করে ফলে,
আমায় তখন দোষ দিওনা, আগেই রাখি বলে ।
এবার আসি এর জনকের কথায়। এর জনক হলেন আমার সবচেয়ে প্রিয় ছড়াকার সুকুমার রায়। সুকুমার রায়ের জন্ম ১৮৮৭ সালের ৩০শে অক্টোবর, কলকাতার এক ব্রাহ্ম পরিবারে। তিনি ছিলেন বাংলা শিশুসাহিত্যের উজ্জ্বল রত্ন উপেন্দ্রকিশোর রায় চৌধুরীর ছেলে। সুকুমারের মা বিধুমুখী দেবী ছিলেন ব্রাহ্মসমাজের দ্বারকানাথ গঙ্গোপাধ্যায়ের মেয়ে।সুবিনয় রায় ও সুবিমল রায় তাঁর দুই ভাই। এ ছাড়াও তাঁর ছিল তিন বোন।
সুকুমার রায় জন্মেছিলেন বাঙালি নবজাগরণের স্বর্ণযুগে। তাঁর পারিবারিক পরিবেশ ছিল সাহিত্যানুরাগী, যা তাঁর মধ্যকার সাহিত্যিক প্রতিভা বিকাশে সহায়ক হয়। পিতা উপেন্দ্রকিশোর ছিলেন শিশুতোষ গল্প ও জনপ্রিয়-বিজ্ঞান লেখক, চিত্রশিল্পী, সুরকার ও শৌখিন জ্যোতির্বিদ। উপেন্দ্রকিশোরের ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, যিনি সুকুমারকে সরাসরি প্রভাবিত করেছিলেন। এছাড়াও রায় পরিবারের সাথে জগদীশ চন্দ্র বসু, আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় প্রমুখের সম্পর্ক ছিল। উপেন্দ্রকিশোর ছাপার ব্লক তৈরির কৌশল নিয়ে গবেষণা করেন, এ নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালান এবং মানসম্পন্ন ব্লক তৈরির একটি ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। মেসার্স ইউ. রয় এন্ড সন্স নামে ঐ প্রতিষ্ঠানের সাথে সুকুমার যুক্ত ছিলেন।
কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে ১৯০৬ সালে রসায়ন ও/অথবা পদার্থবিদ্যায় বি.এসসি.(অনার্স) করার পর সুকুমার মুদ্রণবিদ্যায় উচ্চতর শিক্ষার জন্য ১৯১১ সালে বিলেতে যান। সেখানে তিনি আলোকচিত্র ও মুদ্রণ প্রযুক্তির ওপর পড়াশোনা করেন এবং কালক্রমে তিনি ভারতের অগ্রগামী আলোকচিত্রী ও লিথোগ্রাফার হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন। ১৯১৩ সালে সুকুমার কোলকাতাতে ফিরে আসেন। সুকুমার ইংলান্ডে পড়াকালীন, উপেন্দ্রকিশোর জমি ক্রয় করে, উন্নত-মানের রঙিন হাফটোন ব্লক তৈরি ও মুদ্রণক্ষম একটি ছাপাখানা স্থাপন করেছিলেন। তিনি একটি ছোটদের মাসিক পত্রিকা, 'সন্দেশ', এই সময় প্রকাশনা শুরু করেন। সুকুমারের বিলেত থেকে ফেরার অল্প কিছু দিনের মধ্যেই উপেন্দ্রকিশোরের মৃত্যু হয়। উপেন্দ্রকিশোর জীবিত থাকতে সুকুমার লেখার সংখ্যা কম থাকলেও উপেন্দ্রকিশোরের মৃত্যুর পর সন্দেশ পত্রিকা সম্পাদনার দায়িত্ব সুকুমার নিজের কাঁধে তুলে নেন। শুরু হয় বাংলা শিশুসাহিত্যের এক নতুন অধ্যায়। পিতার মৃত্যুর পর আট বছর ধরে তিনি সন্দেশ ও পারিবারিক ছাপাখানা পরিচালনার দায়িত্ব পালন করেন। তাঁর ছোটভাই এই কাজে তাঁর সহায়ক ছিলেন এবং পরিবারের অনকে সদস্য 'সন্দেশ'-এর জন্য নানাবিধ রচনা করে তাঁদের পাশে দাঁড়ান।
১৯২৩ খ্রিস্টাব্দে কালাজ্বরে আক্রান্ত হয়ে মাত্র সাঁইত্রিশ বছর বয়সে সুকুমার রায় মৃত্যুবরণ করেন, সেই সময় এই রোগের কোনো চিকিৎসা ছিলনা। তাঁর মৃত্যু হয় একমাত্র পুত্র সত্যজিৎ এবং স্ত্রীকে রেখে। সত্যজিৎ রায় ভবিষ্যতে একজন ভারতের অন্যতম চিত্রপরিচালক রূপে খ্যাতি অর্জন করেন, ও নিজের মৃত্যুর ৫ বছর আগে ১৯৮৭ সালে সুকুমার রায়ের উপরে একটি প্রামাণ্যচিত্র প্রযোজনা করেন।
আজ ২৯ মার্চ, রুমীর জন্মদিন। শফি ইমাম রুমী। নামটা কি চিনতে পারছেন?? আমরা আমাদের প্রাত্যহিক জীবনের নানা কাজে কত কিছুই তো ভুলে যাই। এটা ভুলে গেলেই বা ক্ষতি কী! এই রুমীই শহীদ রুমী। গেরিলা যোদ্ধা রুমী।
শফি ইমাম রুমী (২৯ মার্চ, ১৯৫২ - নিখোঁজ ৩০ সেপ্টেম্বর, ১৯৭১) বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের একজন গেরিলা যোদ্ধা। তিনি ছিলেন শহীদ জননী খ্যাত জাহানারা ইমামের জেষ্ঠ্য পুত্র। জাহানারা ইমাম রচিত একাত্তরের দিনগুলি গ্রন্থে রুমীকে অন্যতম প্রধান চরিত্র হিসেবে দেখা যায় এবং তাঁর মৃত্যুর জন্য জাহানারা ইমাম শহীদ জননী উপাধি পান।
শফি ইমাম রুমী ১৯৫২ সালের ২৯ মার্চ ইঞ্জিনিয়ার শরীফ ইমাম ও জাহানারা ইমাম দম্পতির উচ্চ-মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। আই. এস. সি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হবার পর ১৯৭১ সালের মার্চ মাসে রুমী ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে ভর্তি হন। তিনি ইলিনয় ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজিতে সুযোগ পেলেও যুদ্ধ শুরু হয়ে যাবার দরুন আর পড়া হয়ে ওঠেনি।
যুদ্ধের প্রাথমিক পর্যায়ে, রুমী ধারাবাহিকভাবে তাঁর মা ও বাবাকে নিজের যুদ্ধে যাবার ব্যাপারে রাজি করানোর চেষ্টা করেন। অবশেষে ১৯৭১ সালের ১৯ এপ্রিল মাকে রাজি সক্ষম হন। তিনি ২ মে সীমান্ত অতিক্রমের প্রথম প্রয়াস চালান। কিন্তু প্রতিকূল পরিস্থিতির কারণে তাঁকে ফেরত আসতে হয় এবং দ্বিতীয় প্রচেষ্টায় সফল হন। তিনি সেক্টর-২ এর অধীনে মেলাঘরে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। এই সেক্টরটির পরিচালনার দায়িত্বে ছিলেন খালেদ মোশাররফ ও রশিদ হায়দার। প্রশিক্ষণ শেষ করে তিনি ঢাকায় ফেরত আসেন এবং ক্র্যাক প্লাটুনে যোগ দেন। ক্র্যাক প্লাটুন হল পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে গেরিলা আক্রমণ পরিচালনাকারী একটি সংগঠন। রুমী ও তার দলের ঢাকায় আসার অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য ছিল সিদ্ধিরগঞ্জ পাওয়ার স্টেশন হামলা করা। এ সময় তাঁকে ঝুঁকিপূর্ণ আক্রমণ পরিচালনা করতে হয় যার মধ্যে ধানমণ্ডি রোডের একটি আক্রমণ ছিল উল্লেখযোগ্য।
ধানমণ্ডি রোডের অপারেশনের পর রুমী তার সহকর্মীদের মাঝে জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন। ১৯৭১ সালের ২৯ আগস্ট তিনি তাঁর নিজের বাড়িতে কাটান, এবং এই রাতেই বেশকিছু গেরিলা যোদ্ধার সাথে পাক বাহিনীর হাতে ধরা পড়েন। পাকিস্তান হানাদার বাহিনী তাদের টিকটিকিদের মাধ্যমে তথ্য পেয়ে বেশ কিছু সংখ্যক যোদ্ধাকে গ্রেফতার করে যার মধ্যে ছিলেন বদি, চুন্নু, আজাদ ও জুয়েল। রুমীর সাথে তাঁর বাবা শরীফ ও ভাই জামীকেও ধরে নিয়ে যাওয়া হয়। সুরকার আলতাফ মাহমুদও গ্রেফতার হন। জিজ্ঞাসাবাদের স্থানে রুমীকে ভাই ও বাবাসহ একঘরে আনলে রুমী সবাইকে তাদেরকে তাঁর সাথে যুদ্ধে জড়িত থাকার কথা অস্বীকার করতে বলেন। তিনি ব্যাখ্যা করে বলেন যে, পাক বাহিনী তাঁর কর্মকাণ্ড সম্পর্কে সচেতন এবং এর সব দায়দায়িত্ব তিনি নিজেই নিতে চান। ৩০ সেপ্টেম্বরের পর রুমী ও তার সহযোদ্ধা বদী ও চুন্নুকে আর দেখা যায়নি।
ইয়াহিয়া খান ৫ সেপ্টেম্বর ১৯৭১ সালে সাধারণ ক্ষমার ঘোষণা দিলে অনেক আত্মীয় তাঁর জন্য আবেদন করতে বলেন। কিন্তু রুমী যে বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে ধরা পড়েছে, তাঁদের কাছে ক্ষমা চাইতে রুমীর বাবা শরীফ রাজি ছিলেন না। ফলে রুমীর আর ঘরে ফেরা হয়নি।
তথ্যসূত্রঃ উইকিপেডিয়া
চিত্রউৎসঃ শাফি ইমাম রুমীর ফেইসবুক ফ্যান পেইজ
আরো জানতে চাইলে পড়ুনঃ
১। ৭১ এর দিনগুলি - শহীদ জননী জাহানারা ইমাম
২। মা - আনিসুল হক
চে - শুধুমাত্র এক মহান বিপ্লবীর নাম না।এক বিপ্লবী আত্মা।দেহ মরে গেছে।কিন্তু আত্মা থেকে গেছে প্রতিটি বিপ্লবীর চেতনায়।
চে এর সেই মার্ক্সীয় সমাজতন্ত্র আজ হয়তো আর আমাদের দেশের জন্য প্রযোজ্য না।সময়ের সাথে সাথে দাবিও বদলে গেছে।
স্বাধীনতার প্রায় চল্লিশটা বছর চলে গেছে।কী পেয়েছি আমরা??যদি আমরা হতাশাবাদীদের দলে না ভিড়ে থাকি তো দেখতে থাকবোঃ সে মুজিব সরকার থেকে শুরু করে আজকের সরকার, সব সরকারই দেশের জন্য কিছু না কিছু ভালো কাজ করতে চেয়েছে এবং কিছু ভালো কাজ করেছেও।কিন্তু তার সাথে করা খারাপ কাজগুলো বরাবরই তাদের ভালো কাজকে ছাপিয়ে গেছে।তা তাদের ব্যক্তিগত স্বার্থ কিংবা দলীয় স্বার্থ কিংবা ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য বহির্শক্তির স্বার্থই রক্ষা বেশি করেছে অথবা করতে বাধ্য হয়েছে।
এই দেশের জন্মযাত্রা থেকেই নানা বিপ্লব-প্রতি বিপ্লব চলে আসছে।কিন্তু সেখানে সাধারণ মানুষের কথা কে ভেবেছে??সবাই জনগণকে সিড়ি বানিয়ে ক্ষমতার আসনে আরোহণ করতে চেয়েছে।এরাই আজও আমাদের শোষণ করছে।শুধু চরিত্রগুলো সময়ের সাথে বদলেছে।জলপাইদের দল,নৌকা, ধানের শীষ। এখন এসেছে জিহাদী জঙ্গী,তাদের সাথে আছে স্বাধীনতা বিরোধী শক্তি।কিন্তু কেউ কি জানতে চেয়েছে সাধারণ কি চায়??
আমরা, আমাদের বাবা-ভাইয়েরা কি এই উদ্দেশ্যেই রক্ত দিয়েছিল ৭১ এ??নাকি মা-বোনেরা অত্যাচারিত হয়েছিল এই ভবিষ্যত চেয়ে??
স্বাধীনতা মিলে গেলেও, পাওয়া যায় নি এর স্বাদ।আজও জুটেনি মুক্তি।এই মুক্তির জন্য চাই বিপ্লব।বিপ্লবের কোন বিকল্প নেই।বিপ্লব মানেই রক্তপাত না।বিপ্লব মানেই অস্ত্রহাতে ঝাঁপিয়ে পড়া না।সময়ের সাথে বিপ্লবের উদ্দেশ্য বদলায় নি।তবে বদলাতে হবে এর কৌশল।বিপ্লব অনেক ভাবেই আসতে পারে।কৃষি বিপ্লব,শিল্প বিপ্লব, প্রযুক্তির বিপ্লব, রাজনৈতিক বিপ্লব, ভোটের বিপ্লব।সবকিছুর সুষ্ঠু সমন্বয়েই সম্ভব সত্যিকারের মুক্তি।
কিন্তু কোথায় সে কাণ্ডারি??কাণ্ডারি আসছে বলে।অপেক্ষায় না থেকে খুঁজে বেড় করুন।
জয় বিপ্লবের জয়।
সারা বাংলাদেশ পাকিস্তান বিরোধী আন্দোলন জোয়ারে ভাসছে। সবাই স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্নে বিভোর। এত সব ঢেউয়ের মাঝে বড় বড় ঢেউগুলো ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আর তা বাকিসব ঢেউ নিয়ে আছড়ে পরছিল ধানমণ্ডি ৩২ এ নেতার বাড়িতে। ২রা মার্চ, ১৯৭১ ডাকসু র ভিপি আ স ম আব্দুর রব ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমাদের প্রাণের পতাকা উত্তোলন করেন। সেই নিশান একে একে সারা বাংলাদেশে ছড়িয়ে পড়লো। এই পতাকা হয়ে গেল আমাদের প্রাণের পতাকা। এই পতাকা নিয়েই আমরা মুক্তিযুদ্ধ করেছি। পাকিদের নাস্তানবুদ করে বিজয় ছিনিয়ে এনেছি।
এই পতাকার নকশা করেছেন শিব নারায়ণ দাশ। পতাকার সবুজ আমাদের দেশের সবুজ-শ্যামলের প্রতিনিধিত্ব করে। মাঝে লাল বৃত্ত যা প্রকাশ করে মুক্তিকামী মানুষের বুকের তাজা রক্ত। এই রক্ত তিতুমীরের, এই রক্ত সূর্যসেনের, এই রক্ত প্রীতিলতার, এই রক্ত ক্ষুদিরামের, এই রক্ত ভাষা শহীদদের, এই রক্ত নাম জানা-অজানা লাখো শহীদের যারা ধাপে ধাপে এই বাংলার মুক্তির সংগ্রামে রক্ত দিয়েছেন। আর রক্তাক লালের মাঝে বাংলার উদীয়মান সোনালি মানচিত্র। পরে এই পতাকাকে অর্জণ করতে রক্ত দিয়েছে ত্রিশ লাখ শহীদ।
২রা মার্চ আমাদের পতাকার জন্য একটা বিশেষ দিন হলেও এর জন্ম আরো আগেই। ১৯৭০ সালের ৭ জুন তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের রাজধানী ঢাকার পল্টন ময়দানে অনুষ্ঠিত ছাত্রদের এক সামরিক কুচকাওয়াজে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অংশ গ্রহণের কথা ছিল। এই লক্ষ্যে ছাত্রদের নিয়ে জয়বাংলা বাহিনী গঠন করা হয়। ছাত্র নেতারা এই বাহিনীর একটি পতাকা তৈরির সিদ্ধান্ত নেয় ।
এই লক্ষ্যে ১৯৭০ সালের ৬ জুন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্জেন্ট জহুরুল হক হলের (তৎকালীন ইকবাল হল) ১১৬ নং কক্ষে ছাত্রলীগ নেতা আ স ম আবদুর রব, শাহজাহান সিরাজ, কাজী আরেফ আহমদ, মার্শাল মনিরুল ইসলাম পতাকার পরিকল্পনা নিয়ে বৈঠকে বসেন। এ বৈঠকে আরো উপস্থিত ছিলেন ছাত্রলীগ নেতা স্বপন কুমার চৌধুরী, জগন্নাথ কলেজের ছাত্রলীগ নেতা নজরুল ইসলাম, কুমিল্লা জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ও কেন্দ্রীয় ছাত্রনেতা শিব নারায়ণ দাশ, প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগ সাধারণ সাধারণ সম্পাদক হাসানুল হক ইনু ও ছাত্রনেতা ইউসুফ সালাউদ্দিন।
সভায় কাজী আরেফের প্রাথমিক প্রস্তাবনার উপর ভিত্তি করে সবার আলোচনার শেষে সবুজ জমিনের উপর লাল সূর্যের মাঝে সোনালি হলুদ রঙের বাংলার মানচিত্র খচিত পতাকা তৈরির সিদ্ধান্ত হয়। ১৯৭০ সালের ৬ জুন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের শেরে বাংলা হলের ৪০১ নং (উত্তর) কক্ষে রাত এগারটার পর পুরো পতাকার ডিজাইন সম্পন্ন করেন শিব নারায়ণ দাশ।
সেই রাতেই নিউমার্কেট এলাকার বলাকা বিল্ডিংয়ের ৩ তলার ছাত্রলীগ অফিসের পাশে নিউ পাক ফ্যাশন টেইলার্সের টেইলার্স মাস্টার খালেক মোহাম্মদী পতাকার নকশা বুঝে কাজ শুরু করেন। তারা ভোরের মধ্যেই কয়েকটি পতাকা তৈরি করে দেন।
আমাদের আদি পতাকা
আমাদের এই প্রাণের পতাকা উত্তোলনের জন্য কিছু বিখ্যাত দিন হলঃ
জুন ৭, ১৯৭০
৭ জুন ১৯৭০ এ অনুষ্ঠিত কুচকাওয়াজের নেতৃত্ব প্রদান করেন আ স ম আবদুর রব। অল্প পেছনে পতাকা হাতে অধিনায়কের দায়িত্ব পালন করেন হাসানুল হক ইনু। রব সেই পতাকা বঙ্গবন্ধুর হাতে তুলে দেন এবং শেখ মুজিবুর রহমান সেই পতাকা ছাত্র-জনতার সামনে তুলে ধরেন। এরপর ইনু পতাকাটি তার কক্ষে নিয়ে যান এবং সহপাঠি শরীফ নুরুল আম্বিয়া শেরে বাংলা হলের ৪০৪ কক্ষের খবিরুজ্জামানকে পতাকাটি বাক্সে লুকিয়ে রাখতে বলেন। এরপর একাত্তরের শুরুতে নগর ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক শেখ জাহিদ হোসেন পতাকাটি নিয়ে যান তার মালিবাগের বাসায়।
মার্চ ২, ১৯৭১
১৯৭১ এর ১ মার্চ জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত হবার পর ২ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায় এক বিশাল সমাবেশ হয়। এ সমাবেশে আ স ম আবদুর রব যখন বক্তৃতা করছিলেন, তখন নগর ছাত্রলীগ নেতা শেখ জাহিদ হোসেন একটি বাঁশের মাথায় পতাকা বেঁধে রোকেয়া হলের দিক থেকে মঞ্চস্থলে মিছিল নিয়ে এগিয়ে আসেন। রব তখন সেই পতাকা তুলে ধরেন।
মার্চ ২৩, ১৯৭১
১৯৭১ সালের ২৩ মার্চ পাকিস্তান দিবসে সারা বাংলায় পাকিস্তানের পতকার পরিবর্তে শিব নারায়ণ দাশের নকশা করা পতাকা উত্তোলিত হয়।
৭১ এর মুক্তিযুদ্ধে বিজয় লাভ করার পর ১৯৭২ সালে বাংলাদেশ সরকার কোন এক রহস্যময় কারণে [যদিও বলা হয়ে থাকে নকশাকা সহজ করার জন্য] পতাকা থেকে মানচিত্র বাদ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এবং এই কাজটির দ্বায়িত্ব পান পটুয়া কামরুল হাসান। তার হাত ধরেই নব-নকশায় তৈরি হয় আমাদের বর্তমান জাতীয় পতাকা।
আমাদের বর্তমান পতাকা
তথ্যসূত্রঃ উইকিপিডিয়া