সোমবার, ২ এপ্রিল, ২০১২

‘কেয়া পাতার নৌকো’ – ভারতীয় জি-বাংলা চ্যানেলে আমাদের মুক্তিযুদ্ধকে বিকৃত করবার অপপ্রয়াস

কোলকাতা ভিত্তিক ভারতীয় জি-বাংলা আমাদের বাংলাদেশে ব্যাপক জনপ্রিয়। আমাদের দেশের বিভিন্ন চ্যানেল যখন মান সম্পন্ন অনুষ্ঠান বানাতে ব্যর্থ হয়ে দর্শক ধরতে পারছে না, তখন সেই দর্শকদের একটা বিশাল অংশ টেনে নিয়েছে ওপার বাংলার বিভিন্ন বাংলা চ্যানেল। ওরা যে খুব বেশি মানসম্পন্ন অনুষ্ঠান বানাচ্ছেন তা না, তবে তারা দর্শক ধরে রাখবার ব্যাপারে খুবই কৌশলী। আর সেই কৌশলের সহজ শিকার হয়ে আমাদের দেশের মা-বোন-মাসি-পিসি-কাকি-মামি-বোন-বউ-মেয়েরা ভারতীয় বাংলা চ্যানেলে বুদ হয়ে আছেন!

ওপার বাংলার বাংলা চ্যানেলগুলোর মাঝে জি-বাংলা বাংলাদেশে অত্যধিক জনপ্রিয়। আমাদের দেশের মেয়েরা যারা সন্ধ্যা নাগাদ ফ্রি হয়ে যান এবং ঘরে বসেই অবসরটা কাটান তাদের বিশাল একটা অংশ জি-বাংলার সিরিয়ালের দর্শক কাতারে সামিল হন। সন্ধ্যা ৬ টা থেকে রাত ১১ টা পর্যন্তই ওতেই আটকে থাকেন চুম্বকে আটকানো লোহার মতন! বিভিন্ন সিরিয়ালের মাঝে অগ্নিসাক্ষী, কেয়া পাতার নৌকো, কনকাঞ্জলি, সাত পাকে বাঁধা বেশ জনপ্রিয়। এই দর্শকদের বিশাল একটা অংশই এইসব সিরিয়ালগুলোকে মেনে নিয়েছেন নিজ জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে। কিন্তু তার বিনিময়ে কী পাচ্ছেন?? সস্তা বিনোদন!! আর কী?? এর সাথে আরও পাচ্ছেন আমাদের মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে ভুল ধারনা। আর এই কাজটা করে যাচ্ছে কেয়া পাতার নৌকো নামের সিরিয়ালটা!

কেয়া পাতার নৌকো সিরিয়ালটার উৎস হল প্রফুল্ল রায়ের দারুন একটা উপন্যাস কেয়া পাতার নৌকো; যদিও সিরিয়ালের রাইটার প্রফুল্ল রায় নন। এ উপন্যাসটিতে ঔপন্যাসিক দারুন ভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন বাধ্য হয়ে বাংলাদেশ (তৎকালীন পূর্বপাকিস্তান) ত্যাগ করে পশ্চিম বঙ্গে আশ্রয় নেওয়া শরণার্থীদের নিদারুন কষ্ট। বাংলার বাঙালেরা ওপার বাংলার ঘটিদের কাছে কীভাবে তাচ্ছিল্যের শিকার হয়েছেন তা ফুটে উঠেছে উপন্যাসটিতে, আরো ফুটে উঠেছে গত শতাব্দির চল্লিশ থেকে ষাট দশকের পূর্ব বাংলার অপূর্ব চিত্রায়ন। কিন্তু জি বাংলার সিরিয়াল কেয়া পাতার নৌকো এ শুধুমাত্র নামটা ঠিক রাখা হলেও চিত্রকল্পে ঘটেছে ব্যাপক পরিবর্তন। আর এই পরিবর্তনের নামে বাংলাদেশের শ্রেষ্ঠ ইতিহাস ১৯৭১ এর মুক্তিযুদ্ধকে নিয়ে করা হয়েছে পরিহাস!


উপক্রমণিকায় অনেক কথাই হল। এবার চলে যাই মূল কথায়। সিরিয়ালটিতে আমাদের মুক্তিযুদ্ধকে অপপ্রয়াস করবার প্রচেষ্টাগুলোকে তুলে ধরার চেষ্টা করছিঃ

১) পূর্ব পাকিস্তানের সেরা ছাত্র শৌর্য চৌধুরী মুক্তিযুদ্ধে ছদ্মবেশে যুদ্ধ করেন। গালে আলগা দাড়ি লাগিয়ে হয়ে ওঠেন মুক্তিযোদ্ধা রফিকুল। আর অন্যদিকে হিন্দু শৌর্য চৌধুরীর মুসলমান প্রেমিকা নার্গীস ওরফে কিরণমালা মুক্তিযুদ্ধ করতে নাম নেন সুলেখা দেবি। আমাদের মুক্তিযুদ্ধে যুদ্ধ করতে যে হিন্দুদের মুসলিম আর মুসলিমদের হিন্দু পরিচয় নিতে হত এরকমটা জানা ছিল না!!

২) মুক্তিযোদ্ধা রফিকুল তার গালে আলগা দাড়ি লাগিয়ে ছদ্মবেশ ধারণ করতেন। আলগা দাড়ি!! অথচ আমাদের প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধারা যুদ্ধকালীন সময়ে কবার দাড়ি কামানোর সুযোগ পেয়েছেন সেটা ভেবে দেখা প্রয়োজন।

৩) কেয়া পাতার নৌকো তে মুক্তিযোদ্ধাদের পোষাকের ব্যাপারটা চোখে লাগার মতন। ওখানে দেখায় মুক্তিযোদ্ধারা পায়জামা আর পাঞ্জাবি পড়ে যুদ্ধ করেন!! পুরো সিরিয়াল জুড়েই এমন একটা ভাব যেন পায়জামা-পাঞ্জাবি তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের জাতীয় পোষাক, আর নিত্যপরিধান কর্তব্যের মাঝে পড়ে!! অথচ আমাদের মহান মুক্তিযোদ্ধারা শুধুমাত্র লুঙ্গি পড়া অবস্থায় দেশের জন্য ঝাঁপিয়ে পড়েছেন।

৪) আমাদের মুক্তিযুদ্ধে নারীদের অবদান পুরুষদের চেয়ে কোন অংশেই কম না। তারা বিভিন্ন জায়গাতে সক্রিয়ভাবে অংশ করেছেন। তাদের প্রতি পূর্ণ সম্মান জানিয়েই বলছি আমাদের নারীরা মুক্তিযুদ্ধের অনেক অবদান রাখলেও ফ্রন্ট লাইন যুদ্ধে একটু কম সক্রিয় ছিলেন যা তৎকালীন সমাজে এটা খুবই স্বাভাবিক ছিল; কিন্তু কেয়া পাতার নৌকো তে দেখানো হয় মুক্তিযুদ্ধে নারী ইউনিটগুলোই পুরুষ ইউনিটের চাইতে বেশি সক্রিয় ছিল!! নারী ইউনিটের ট্রেনং দেন পুরুষেরা, দলে থেকে নারীদের সাহস যোগান পুরুষেরা কিন্তু সেই পুরুষেরা যুদ্ধের সময়ে যান না!!

৫) এখানে দেখানো হয় কীভাবে অসীম সাহসিকতায়(!!) কিরণমালা খানসেনাদের কাছ থেকে যুদ্ধের কৌশল আর মানচিত্র জয় করে। এদের যে আমাদের দেশের গেরিলা যুদ্ধ সম্পর্কে কোনই ধারণা না তা আর বুঝতে বাকি নেই।

৬) পুরো যুদ্ধজুড়ে মুক্তিযোদ্ধা রফিকুল ও তার সহযোদ্ধারা পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে রিভলভার নিয়ে!!

৭) কেয়া পাতার নৌকো তে খান সেনাদের দেখানো হয় দাড়িওলা ও আলখাল্লাসম পাঞ্জাবি পরিহিতাবস্থায়। খানসেনাদের এইরূপ এই প্রথম দেখা!!

৮) কেয়া পাতার নৌকো তে আরো দেখানো হয় আর সারাদেশব্যাপী বাঙালিদের উপর আক্রমণ করে মুলত পুলিশেরা, পাক-বাহিনী না। এবং পুলিশেরা মূলত এদেশি। অথচ ২৫ মার্চ রাতেই আমাদের পুলিশ ভাইদের নির্মমভাবে হত্যা করে পাকসেনারা। খুব কম পুলিশই ব্যারাক থেকে বেঁচে ফিরতে পেরেছেন।

৯) সিরিয়ালটিতে খানসেনারা সবাইই বাংলায় পারদর্শী এবং বাংলাতেই বাক-চিৎ করেন!!

১০) সিরিয়ালটির এক পর্যায়ে কিরণমালাকে তার প্রাক্ত স্বামী দাড়িওলা রাজাকার কাবুল শেখ ও পাঞ্জাবি পরিহিত খানসেনারা আটক করে এবং গুলি করে। কাবুল শেখ নিজে কিরণমালার বুকে ও পেটে গুলি করে। কিন্তু এত গুলি খেয়েও কিরণমালা মরে নি!

১১) এবং সর্বশেষ গতকাল দেখানো হয়েছে এক রাজাকার এক হিন্দু বনেদি পরিবারকে ভারত চলে যেতে বলে। কিন্তু তার বাড়ি সে দখল করতে চায় না বরং দু'লাখ টাকা দিয়ে কিনতে চায়!! সত্যিই রাজাকারদের এই মহানুভবতায় আমি বিস্মিত না হয়ে পারলাম না!!!

এরকম আরোও অনেক অসামঞ্জস্যতার মাধ্যমে আমাদের মুক্তিযুদ্ধকে হেয় করা হয়েছে এবং ওই মহান যুদ্ধের ইতিহাসকে করা হয়েছে বিকৃত।

কেয়া পাতার নৌকো সিরিয়ালটিতে যদিও ডিসক্লেইমার দেয়া হয় যে ঐ সিরিয়ালটির সকল ঘটনা ও চরিত্র কাল্পনিক, কোন ঘটনা কিংবা ব্যক্তির সাথে মিল পাওয়া গেলে তা নিহায়েতই কাকতালীয়!! কিন্তু ঘটনা হয় যখন একটা দেশ ও জাতি এবং সেই দেশ ও জাতির মুক্তির ইতিহাস তখন আর একে কাকতালীয় বলে চালানোর অবকাশ থাকে না। আমি তীব্রঘৃণাসহকারে ধিক্বার জানাই ভারতীয় জি-বাংলা কর্তৃপক্ষকে এবং বাংলাদেশের দর্শকদের এই সিরিয়াল ও জি-বাংলা চ্যানেলটিকে বর্জণের আহ্ববান জানাই।