মঙ্গলবার, ২৮ আগস্ট, ২০১২

দ্বাদশপদী কবিতা - ৪

একাকীত্ব-ক্লেশ

অদৃষ্ট ক্ষরণ-স্রোত বয়ে যায় হৃদয়ে।
কাল্‌-তরঙ্গে ব্যথা তবু না যায় সয়ে।
দিবা কিবা রাতি থাকি আশে আশে,
স্বপন মাঝে যদি আসে মোর পাশে।
স্বপন বিনে সে যে না দিবে ধরা,
ভালোবাসাহীন নীলয়ে সে অধরা।
মরীচিকা মাঝে কাপেঁ ছবিখানি,
পরশহীনা সে ধূমায়িত হাতছানি।
এ চঞ্চল চপল মন সদা খোঁজে তারে,
ধূমকেতু হারিয়ে যায় গভীর আঁধারে।
অধরা প্রিয়া মোর অধরাই র'বে।
একাকীত্ব-ক্লেশ বেশ! এ অলিন্দে স'বে।


২৮ আগস্ট, ২০১২; ঢাকা
দেবাশিস্‌ মুখার্জি

অন্যান্য দ্বাদশপদী কবিতাঃ
দ্বাদশপদী কবিতা - ৩
দ্বাদশপদী কবিতা - ২
দ্বাদশপদী কবিতা - ১

সোমবার, ২৭ আগস্ট, ২০১২

আমি এক ছাইওয়ালী...



আমি এক ছাইওয়ালী,
ঘরে ঘরে ছাই বেঁচি।
বস্তাটা কাঁধে নিয়ে পথে পথে হাঁটি,
আর সুর করে হাঁকি,
'ছাই নিবেন ছাই...
সাদা ছাই...
কালো ছাই...
ছাই নিবেন ছাই...'

বড়লোক এলাকাতে যাই না আর,
ওদের ভিম আছে, লাগে না ছাই!
গরিব এলাকার সরু গলি ধরে হাঁটি,
আর সুর করে হাঁকি,
'ছাই নিবেন ছাই...
সাদা ছাই...
কালো ছাই...
ছাই নিবেন ছাই...'
কোন এক লোক এসে দেয় রাম-ঝাড়ি,
'চিল্লানোর জায়গা পাওনা বেটি?
আমার ঘুম হল মাটি...
কোন এক ঘরের ছোট্ট খোকা,
ফেলে আমার গায়ে জল।
জল ফেলে কী যে খুশি!
কোন এক খুকি ভেংচি কাটে,
কেউ বা গলা ছাড়ে আমার সুরে,
'ছাই নিবেন ছাই...'
কোন এক বুড়ো মা একটু চ্যাঁচায়,
'এদে শোর পারে কিডা?'

রোদ বাড়ে আমি পুড়ি,
বৃষ্টি পড়ে আমি ভিজি,
শীত আসে আমি কাঁপি,
আমার দিন চলে যায়।
আমি হেঁটে চলি সরু গলি ধরে,
কেউ ডাকে কিনা দেখি চারদিকে।
কেউ চাইলে বেঁচিঃ
সাদা ছাই! 
কালো ছাই!
পাঁচ টাকায় দশ পট!
ঐ বেঁচে ফিরি বাড়ি, 
বুড়ো বাবা-মা ঘরে।
আমার ছাই-বেঁচা টাকায়
চাল কিনলে পরে খাওয়া হবে,
নয়তো তিনজনেই শুয়ে রবো অনাহারে।
রাতটা ছুটে চলে শুভড্যা বস্তিতে।

সবার ঘরে জ্বলে আলো,
জীবনে লাগে রঙ...
আমার অন্ধকারে দু'টো রঙ -
সাদা ছাই, কালো ছাই।
আমি ছাই ওড়াই,
কোন রতন আর পাওয়া হয় না।
ঐ ছাইই আমার রতন, আমার বন্ধু,
হয়তো বা মরণের সাথী!
মরণের দিনটাতেও হাঁটবো পথে,
আর হাঁকবো সুরে,
'ছাই নিবেন ছাই...
সাদা ছাই...
কালো ছাই...
ছাই নিবেন ছাই...'


২৭ আগস্ট, ২০১২
দেবাশিস্‌ মুখার্জি

রবিবার, ২৬ আগস্ট, ২০১২

ফুলবাড়ির কথা

ফুলবাড়ির কান্না
ফুলবাড়ি কাঁদেরে
লাশ নিয়ে কাঁধেরে,
আর হাসপাতাল আছে শুয়ে
র'বে না তারা নুয়ে,
শ'খানেক লোক।
চারদিকে তাকালেই শোক আর শোক।

ফুলবাড়ির লোকেরা নয় যেন মানুষ!
তাই বিডিআরে করে গুলি 'ঠুশ ঠাশ ঠুশ...!'
ক্ষমতার নির্দেশে কত লাশ পড়ে,
আর কিছু বামনেতা 'আহা-উহু' করে!
ফুলবাড়ি জেগে রয় কান্নার ধূমে,
আর বাকি বাঙালি পড়ে রয় ঘুমে!
কিছু লোকে ছবি তোলে প্রমোশনের লোভে!
কিছু লোকে লিখে যায় রাজনীতি-ক্ষোভে!
লাশ হবে যত লাভ হবে তত!
দেখেও কেউ বুঝবে না হৃদয়ের ক্ষত।
গদিখানা বাঁচাতে নেতা যাবে ছুটে,
কত শত কথা দিবে।
ফটোগ্রাফার ছবি নিবে,
সময়ের সাথে সাথে হয়ে যাবে চুপ!
লাশ ফেলে খোঁড়া হবে কয়লার কূপ!
ঐ ফুলবাড়ি লাথ খাবে ক্ষমতার বুটে।
কবিতাটা ২৬ আগস্ট, ২০০৬ এ ফুলবাড়ি আন্দোলনে গুলি চালানোর রাতে লেখা। ঐদিন চারদলীয় জোট সরকার ও এশিয়া এনার্জির আঁতাতের বহির্প্রকাশ রূপে আন্দোলনে গুলি চালানো হয়। আল-আমিন, সালেকিন ও তরিকুল নামের তিনজন নিহত হয়। গুলবিদ্ধ হয় কুঁড়িজন, আর প্রায় দু'শ লোক আহত হয়। রক্তাক্ত আন্দোলনের মুখে চারদলীয় জোট সরকার আপাতভাবে পিছু হটতে বাধ্য হয়। ৩০ আগস্ট ঐতিহাসিক 'ফুলবাড়ি চুক্তি' সাক্ষরিত হয়। চুক্তির মূল বক্তব্য ছিল 'এশিয়া এনার্জি'-কে বিতাড়ন, উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা উত্তোলন নিষিদ্ধ করা এবং জনগণের সম্মতির ভিত্তিতে কয়লা বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ। তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেত্রী শেখ হাসিনা ঐ চুক্তিকে জনগণের বিজয় বলে এর সাথে পূর্ণ সংহতি প্রকাশ করেন। তিনি বলেন,
'ফুলবাড়ি চুক্তি বাস্তবায়ন না করার পরিণতি হবে ভয়াবহ' [১]
চারদলীয় সরকারের সময় শেষ হয়ে যায় কিছুদিন পরেই। এরপর আসে সামরিধায়ক সরকার। এরপর তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেত্রী শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী হয়ে নতুন সরকার পরিচালনা করেছেন কিন্তু ঘটনার কোন পরিবর্তন ঘটেনি শুধু খোলস বদলেছে।

এবার ফুলবাড়ি কয়লা প্রকল্পের ইতিহাসটা সংক্ষেপে তুলে ধরবার চেষ্টা করি।
প্রকল্পের অবস্থান 
প্রকল্প এলাকা ঢাকা থেকে ৩৫০ কিলোমিটার দূরে বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিমে এবং দিনাজপুর জেলার ফুলবাড়ী, নওয়াবগঞ্জ, বিরামপুর ও পার্বতীপুর উপজেলার মধ্যে অবস্থিত।
ফুলবাড়ী একটি ছোট শহর যা জাতীয় প্রধান সড়ক ও উত্তর-দক্ষিণাঞ্চলীয় রেলওয়ের সাথে যুক্ত এবং এর ৪০ কিলোমিটার উত্তরে সৈয়দপুর বিমানবন্দর অবস্থিত। ফুলবাড়ী থেকে ১৮ কিলোমিটার উত্তরে অবস্থিত পার্বতীপুর একটি গুরুত্বপূর্ণ রেলজংশন এবং এর সঙ্গে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের রেল সংযোগ রয়েছে।
এই প্রকল্পটি বরেন্দ্র এলাকায় অবস্থিত, যা একটি উঁচু মালভূমি এবং সমুদ্র পৃষ্ঠের ২৫-৩২ মিটার উচ্চতায় অবস্থিত। বরেন্দ্র এলাকার কিঞ্চিত উঁচু ভূ-প্রকৃতির কারণে সমীক্ষা এলাকাটি সাধারণভাবে বন্যামুক্ত। এই এলাকায় তাপমাত্রা গ্রীষ্মকালে সর্বোচ্চ ৩৩ ডিগ্রী সেলসিয়াস এবং শীতকালে সর্বনিম্ন ১০ ডিগ্রী সেলসিয়াস, মে মাসের শেষদিক থেকে অক্টোবর পর্যন্ত ভারী ধরনের বৃষ্টিপাত হয়। বছরে গড় বৃষ্টিপাত ১,৮০০ মিলিমিটার।
প্রকল্প উদ্যোক্তা
এশিয়া এনার্জি করপোরেশন (বাংলাদেশ) প্রোঃ লিঃ, যা লন্ডন ভিত্তিক জিসিএম রিসোর্সেস পিএলসির (ভূতপূর্ব এশিয়া এনার্জি পিএলসি) বাংলাদেশী সাবসিডিয়ারী।
মোট বিনিয়োগ

খনির মেয়াদকালে মোট বিনিয়োগ ২০০ কোটি মার্কিন ডলার যার অর্ধেকের বেশী খনি উন্নয়নের সময় ব্যয় হবে।
চুক্তি
কয়লার অনুসন্ধান ও খনি উন্নয়ন করার জন্য এশিয়া এনার্জি এবং বাংলাদেশ সরকারের মধ্যে চুক্তি সম্পাদিত রয়েছ।
লাইসেন্স
এশিয়া এনার্জি মূল কয়লা সম্পদ এলাকার খনি ইজারা এবং তদ্‌সংলগ্ন অন্যান্য এলাকার অনুসন্ধান লাইসেন্স পেয়েছে (বর্তমানে তা খনি ইজারায় রূপান্তরের জন্য আবেদনকৃত ও বিবেচনাধীন রয়েছে)।
বর্তমান অবস্থা
দু-বছরব্যাপী জাতীয় ও আন্তর্জাতিক মানের বিস্তারিত সম্ভাব্যতা সমীক্ষা সমাপ্ত হয়েছে এবং পরিবেশগত ছাড়পত্র পাওয়া গেছে।
খনি পদ্ধতি
উন্মুক্ত খনন পদ্ধতি।
কয়লা
বিটুমিনাস জাতীয় কয়লা (উচ্চ তাপমান সম্পন্ন, অল্প ছাই ও অল্প সালফার যুক্ত)- তাপীয় (থারমাল) ও সেমিসফট কোকিং কয়লা।
মোট কয়লা সম্পদের মজুদ
৫৭২ মিলিয়ন টন (দক্ষিণে ড্রিলিং করলে যার পরিমাণ আরো বাড়বে বলে আশা করা যায়)।
বাৎসরিক উৎপাদন ক্ষমতা
১৫ মিলিয়ন টন।
সহ-সম্পদ
কাদা, বালি, নুড়ি, চীনামাটি (কেওলিন), পান।
প্রকল্প এলাকা
দিনাজপুর জেলার ৪ টি উপজেলা ফুলবাড়ী, বিরামপুর, নবাবগঞ্জ ও পার্বতীপুর এর অধীন ৭টি ইউনিয়ন ও একটি পৌরসভার অংশ প্রকল্প এলাকার ভিতরে অবস্থিত।
প্রকল্পের মোট প্রয়োজনীয় জমি
খনির মেয়াদকালে প্রায় ৫,৯৩৩ হেক্টর জমির প্রয়োজন হবে। তবে খননের জন্য প্রকল্পভুক্ত জমির এক তৃতীয়াংশ ব্যবহৃত হবে এবং তা হবে পর্যায়ক্রমে।
ফুলবাড়ী শহর
পৌরসভা ঠিক থাকবে তার পুনঃনির্ধারিত সীমানা নিয়ে। পূর্ব ফুলবাড়ীর খুব সামান্য অংশ খনির ভিতরে পড়বে এবং একটি নতুন শহর ছোট যমুনা নদীর পশ্চিম পাশে বিদ্যমান পশ্চিম ফুলবাড়ীর বর্ধিতাংশরূপে গড়ে উঠবে।
জনগোষ্ঠীর স্থানান্তর ও পুনর্বাসন
খনির মেয়াদকালে প্রায় ৪০,০০০ ব্যক্তিকে (যার বেশিরভাগ প্রথম দশ বছরে) স্থানান্তরের প্রয়োজন হবে।
পুনঃস্থাপন
প্রকল্পের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত সকলকে প্রয়োজনে বা তাদের ইচ্ছানুযায়ী নতুন সম্প্রসারিত শহর অথবা নতুন উন্নত গ্রামে পুনর্বাসন করা হবে।
ক্ষতিপূরণ
প্রকল্পের কারণে ক্ষতিগ্রস্তদের জমি, সম্পদ ও জীবিকার উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ দেয়া হবে। ক্ষতিগ্রস্তদের দেয়া হবে নগদ অর্থ, জমি, বাড়ি, উন্নততর জীবন-যাপনের সুবিধা, উন্নততর শিক্ষা ও চিকিৎসা সুবিধা, প্রশিক্ষণ, বিকল্প জীবিকার সুযোগ এবং সমাজ উন্নয়ন তহবিল হতে সহায়তা। তাদের কেউ বর্তমানের অবস্থা থেকে খারাপ অবস্থানে যাবে না বরং অধিকাংশের অবস্থা হবে উন্নততর।
খনি পুনর্বাসন
উন্মুক্ত খনি ক্রমান্বয়ে ভরাট করে আগের প্রাকৃতিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনা হবে; শেষাংশে খাদটি একটি স্থানীয় জনগোষ্ঠির পানি সরবরাহ, বিনোদন ও মৎস্যচাষের জন্য একটি মিঠা পানির লেকে রূপান্তর করা হবে। খনি উন্নয়নকালে খনিখাদ শুঙ্ক রাখার জন্য খনি এলাকায় পানি উত্তোলন করতে হবে এবং এ পানি কৃষিজমি ও বসতবাটিতে সরবরাহ করা হবে। কিছু পরিমাণ পানি সরবরাহ করা হবে নতুন শহর ও অন্যান্য পুনঃস্থাপন এলাকায়। আশুরার বিলের প্রতিবেশ ব্যবস্থা ও প্রাকৃতিক আবাস সংরক্ষণের জন্যও কিছু পানি সরবরাহ করা হবে। এতে প্রকল্প এলাকায় পানির অভাব হবেনা এবং প্রকল্পের কারণে কোন এলাকা শুকিয়ে যাবেনা। এ সংক্রান্ত বিস্তারিত পৃথক সমীক্ষা করা হয়েছে।
পরিবেশ
জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ করা হবে এবং শব্দ, ধূলা ও বর্জ্যপানি গ্রহণযোগ্য মানমাত্রার ভিতরে রাখা হবে। পরিবেশগত সকল উপাদান সবসময় পর্যবেক্ষণাধীন রাখা হবে এবং খনির মেয়াদকালে সকল কার্যক্রম যাতে পরিবেশগতভাবে গ্রহণযোগ্য মাত্রার ভিতরে থাকে তা নিশ্চিত করতে বিস্তারিত পরিবেশ ব্যবস্থাপনা পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা হবে।
বাংলাদেশ সরকারের লাভ/প্রাপ্তি
বিনিয়োগ ও ঝুঁকি শূন্য। লাভের প্রায় ৫০% প্রাপ্তি ছাড়াও (এর অন্তর্ভুক্ত ৬% রয়্যালটি, ৪৫% কর্পোরেট ট্যাক্স এবং ২.৫% আমদানী শুল্ক) অন্যান্য প্রাপ্তির মধ্যে রয়েছে দেশে একটি সহজলভ্য দীর্ঘ মেয়াদী নতুন জ্বালানী শক্তির উৎস, বিদ্যুৎ উৎপাদন, নতুন শিল্পক্ষেত্র, নতুন রেল ও বন্দর অবকাঠামো, সম্ভাবনাময় সহযোগী শিল্পের বিকাশ, চাকুরীর সুযোগ সৃষ্টি, আঞ্চলিক উন্নয়ন, এবং দারিদ্র বিমোচন। [২]

ফুলবাড়ি কয়লা প্রকল্প হতে 'এশিয়া এনার্জি' এর দাবিকৃত সুবিধাসমূহ হলঃ
জাতীয় ও আঞ্চলিক পর্যায়ে ইতিবাচক অর্জন 
জাতীয়
• প্রতি বছর জাতীয় জিডিপি-তে ১.০% সংযোজন
• প্রকল্প মেয়াদকালে জিডিপি-তে ২১ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের অবদান
• ট্যাক্স ও রয়্যালটির মাধ্যমে সরকারের ৫.৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার সরাসরি আয়
• ব্যালান্স অব পেমেন্টের উপর বছরে ২৫০ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের ইতিবাচক প্রভাব
• বাংলাদেশ রেল-এর নীট আয় ১.৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার
• দারিদ্র দূরীকরণ ও টেকসই উন্নয়ন
• টেকসই বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য বিকল্প জ্বালানীর নিশ্চয়তা
বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চল
• উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে নতুন কয়লা শিল্পের উন্নয়ন
• এশিয়া এনার্জি কর্তৃক পরিচালিত ১,০০০ মেগাওয়াট ক্ষমতা সম্পন্ন বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র
• সম্ভাব্য বিনিয়োগকারী কর্তৃক আরো কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র স্থাপন
• প্রায় ১২,০০০ নতুন স্থানীয় কর্মসংস্থান (প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ)
• সহসম্পদ (কো-প্রডাক্ট) নির্ভর এবং খনি সহযোগী বেশ কিছু নতুন শিল্প-কারখানা স্থাপন
• প্রকল্পের মেয়াদকালে ৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ব্যয়
• পুনঃস্থাপন ও নতুন শহরের জন্য ৩০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার বিনিয়োগ
• স্থানীয় নীট কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি
• উন্নত সুবিধাসহ নতুন পরিকল্পিত শহর ও গ্রাম
বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল
• পশ্চিম রেলের পথের উন্নতি
• খুলনায় কয়লা টার্মিনাল স্থাপন
• আকরাম পয়েন্টে গভীর সমুদ্র কার্গো হ্যান্ডলিং সুবিধা
• খুলনা ও মংলা বন্দরের অর্থনৈতিক অবকাঠামোর পুনরুজ্জীবন ও উন্নয়ন
• প্রায় ৮,০০০ হাজার নতুন কর্মসংস্থান (প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ)
• বন্দর উন্নয়নে ২৩০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার বিনিয়োগ
• স্থানীয়ভাবে কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র স্থাপনের সম্ভাবনা
• সহসম্পদ ভিত্তিক শিল্প-কারখানা স্থাপনের সম্ভাবনা [৩]

'এশিয়া এনার্জি' বিভিন্ন লাভের কথা ধরলেও কোথাও এই প্রকল্পের সমস্যার ব্যাপারগুলো পরিষ্কার করা হয় নি। উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা উত্তোলনের মূল সমস্যাগুলো হলঃ

১) এটি খুবই জটিল একটি প্রক্রিয়া এবং এর মাঝে অনেকগুলো অংশ থাকে, এবং এর কোন এক অংশের সম্যস্যার জন্য পুরো প্রক্রিয়াটি বন্ধ থাকবে। তাই ৩৫ বছরের প্রকল্প আদৌ ৩৫ বছরে শেষ হবে কি না সন্দেহ আছে।

২) এই পদ্ধতিতে কয়লা উৎপাদনে ডাস্টের পরিমাণ অনেক বেশি হবে যা পরিবেশের জন্য খুবই ক্ষতিকারক।

৩) এশিয়া এনার্জি ফুলবাড়ি থেকে প্রতিদিন গড়ে ৬০০ মিলিয়ন লিটার পানি তোলা হবে বলে জানিয়েছে। খনি উন্নয়ন এবং পরিচালনার ৩৮ বছর জুড়ে এই পানি তোলা হবে। এর মাত্র ১৫ ভাগ তারা রিইনজেক্ট করবে। এতে করে ওই এলাকার পানি সরবরাহ এবং কৃষি কাজে পানিপ্রাপ্তি একটি বড় সমস্যা হয়ে দেখা দেবে।

৪) প্রকল্প শেষে খনি পুনর্বাসন প্রক্রিয়াটি একটি জটিল প্রক্রিয়া, এবং এটি সফল না হবারও সম্ভাবনা আছে। এবং পানিস্তর আগের পর্যায়ে মিলিয়ে দেওয়াটা খুবই কঠিন। এই এলাকার মানুষ তিস্তা ও মহানন্দা বাঁধের কারণে এমনিতে পানির কষ্টে আছে, তাই খনি পুনর্বাসন সফল না হলে পুরো এলাকা মরুতে পরিণত হতে পারে।

এত সমস্যার পরেও ‘এশিয়া এনার্জি’ কেন সুরঙ্গ পদ্ধতিতে খনন না করে উন্মুক্ত পদ্ধতিতেই কয়লা উত্তোলন করতে চাচ্ছে এ প্রশ্ন আসাটা খুবই স্বাভাবিক। এর কারণটা হল আর্থিক লাভ। উন্মুক্ত পদ্ধতিতে যেখানে ৯৫-৯৮% কয়লা উৎপাদন সম্ভব সেখানে সুরঙ্গ পদ্ধতিতে সর্বোচ্চ ৬৫-৭০% কয়লা উত্তোলন সম্ভব। [৪]

এবার ‘এশিয়া এনার্জি’ এর ফুলবাড়ি কয়লা প্রকল্পের বর্ণনায় আরো কিছু অসামঞ্জস্যতা ও সমস্যা পরিলক্ষিত হয়ঃ

১) প্রকল্পকালে ৪০,০০০ লোক সরিয়ে নিতে হবে বলা হলেও প্রকৃতপক্ষে এই সংখ্যাটা লক্ষাধিক হতে পারে। আমাদের মত ছোট একটা দেশে এত লোককে অন্যত্র সরিয়ে নেওয়া খুবই কঠিন হবে।

২) অনেক কৃষি জমিও এই প্রকল্পের আওতাভূক্ত হবে, তাই এই প্রকল্প আমাদের কৃষিক্ষেত্রেও বিরূপ প্রভাব রাখবে।

৩) প্রকল্পের ব্যবসায়িক হিসেবে শুধুমাত্র কয়লাই দেখানো হয়েছে কিন্তু উপজাত হিসেবে পাওয়া বালি, নুড়ি, চিনামাটির হিসেবটা কী হবে আর কে পাবে তা পরিষ্কার না।

৪) চুক্তি অনুযায়ী বাংলাদেশ সরকার মাত্র ৬% রয়ালটি পাবে এবং কয়লার সাথে তেল, গ্যাস কিংবা মহামূল্যবান হীরে পাওয়া গেলে কী হবে সেটা পরিষ্কার না।

৫) বলা হয়েছে উত্তোলিত কয়লা দিয়ে ‘এশিয়া এনার্জি’ ১০০০ মেগাওয়াটের বিদ্যুৎ উৎপাদন প্রকল্প হাতে নেবে। অর্থাৎ ‘এশিয়া এনার্জি’ বিদ্যুৎ উৎপাদন করে আমাদের কাছেই বিক্রি করবে না প্রতিবেশীদেরকে দিতে পারবে ব্যাপারটা পরিষ্কার না। আর উৎপাদিত বিদ্যুতের দামই বা কী হবে সেটাও কোথাও বলা হয় নি। তাই ওরা চাইলেই আমাদেরকে বেশি দামে বিদ্যুৎ কিনতে বাধ্য করতে পারে, এবং সে সম্ভাবনা প্রবল।

সরকার এত সব সমস্যা বিবেচনা না করে ব্যবসায়ী ‘এশিয়া এনার্জি’ এর পক্ষেই তার অবস্থান নিয়েছে ৫], এবং হয়তো তারা বাহ্যিক চাপে কিছুটা দিশেহারা, অসহায়। টাকার অঙ্কে এই প্রকল্পের লাভ নিরূপন করা হচ্ছে কিন্তু লোকসানটা টাকার অঙ্কে পরিমাপ করা সম্ভব হবে না। আর ফুলবাড়িবাসী কি সরকারের এই অবস্থান বিনে বাঁধায় মেনে নেবে?! সে সম্ভাবনা অন্যরা দেখলেও অন্তত আমি দেখছি না। ফুলবাড়ি এখনো জেগে আছে। আর বাকি দেশবাসিও হয়তো তাদের পাশে থাকবে। কেউ পারতপক্ষে ফুলবাড়ির সর্বনাশ মেনে নেবে না। তাই এখনো আন্দোলন চলছে, এবং আশা করি চলবে।




তথ্য উৎসাবলিঃ
[১] দৈনিক প্রথম আলোতে প্রকাশিত আনু মুহাম্মদের কলাম 'ফুলবাড়ী চুক্তি বাস্তবায়ন না করার পরিণতি হবে ভয়াবহ'
[২],[৩] ফুলবাড়ি কয়লা প্রকল্পের অফিসিয়াল ওয়েব সাইট - 'ফুলবাড়ী কয়লা প্রকল্প'
[৪],[৫] দৈনিক জনকণ্ঠ


চিত্র-উৎসঃ
[১] বিপ্লব রহমান-এর ব্লগ 'ফুলবাড়ি- লাল সেলাম!, উন্মোচন ব্লগ

শনিবার, ১৮ আগস্ট, ২০১২

আলফ্রেড সরেনদের কথা

‘এ ফুল দেলা ফুল
রেলগাড়িরে দেজোক ফুলেম তাইনমোক কান
রেলগাড়িরে দেজোক দাই বগেতেঞ বতোরক
রেলগাড়িরে বাঞদেজোক, দুমকা দিসম বাঞঞেল
ইঞদঞ রুয়াড় চালাক অড়াক তেগে।’
বাংলা করলে এর অর্থ দাঁড়ায়,
‘এই ফুলমনি তাড়াতাড়ি চলো
ট্রেন দাঁড়িয়ে আছে; দেরী হয়ে যাচ্ছে।
আমার খুব ভয় করে, আমি ট্রেনে উঠবো না,
আমি দুমকা জেলাও দেখব না,
আমি বাড়িতে ফিরে যাবো’
এই ফুলমনি একজন সাঁওতাল নারী। সিদু-কানুর বোন ফুলমনির লাশ মিলেছিল রেল-লাইনের ধারে। তার গায়ের কাপড় ছিল ছিন্ন-ভিন্ন। খুব সম্ভবত ব্রিটিশ সৈন্যরা ফুলমনিকে ধর্ষণ করে, খুন করে লাশটা ফেলে রেখে যায় রেল-লাইনের ধারে। সাঁওতালীরা আজও ফুলমনিকে স্মরণ করে, আজও কাঁদে।

পেছনের দিকে তাকালে পাই,


আজ থেকে ১৫৭ বছর পূর্বে ১৮৫৫ খ্রি. ৩০ শে জুন সান্তাল (সাঁওতাল) বিদ্রোহের বীজ মহিরুহে পরিণত হয়েছিলো। ইতোপূর্বে ১৭৭২ খ্রিষ্টাব্দ ক্যাপ্টেন ব্র“কের নেতৃত্বে একদল সিপাহী নিয়ে অরণ্যচারী আদিবাসীদের বশে আনার প্রথম ব্যর্থ উদ্যোগ ছিলো। দ্বিতীয় উদ্যোগ গ্রহণ করেন বুদ্ধিমান ও বিচক্ষণ ইংরেজ প্রশাসক (কালেক্টর) আগষ্টাস ক্লিভল্যাণ্ড ১৭৭৯ খ্রিষ্টাব্দে। এতদিন আদিবাসীরা স্বাধীনভাবে চাষবাস করেছে, অরণ্যের সম্পদ ভোগ করেছে কিন্তু এবার ইংরেজদের খাজনা দিতে হবে। খাজনা প্রদানকে তারা তাদের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ মনে করলো। তারা খাজনা প্রদানে অস্বীকার করলো। ফলে কোম্পানীর কর্মচারী ও সিপাহীরা আদিবাসীদের ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দিতে শুরু করলো। তাদের ধরে বেঁধে ভাগলপুর নিয়ে গিয়ে অমানুষিক ও অমানবিক নির্যাতন শুরু করলো। আদিবাসী অরণ্যচারীরা বিদেশী ইংরেজ শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াল। এদের নেতৃত্ব দিলেন তিলকা মাজহী বা তিলকা মুরমু। শুরু হলো আদিবাসী সাঁওতাল বিদ্রোহ। অস্ত্র তাদের নিজেদের তৈরি বাঁশের তীর-ধনুক, বাটুল, বর্শা ইত্যাদি। তিলকা মাজহীর গেরিলা আক্রমণ নীতিতে ইংরেজ সৈন্যরা বার বার মার খেল। ১৭৮৪ খ্রিষ্টাব্দের ১৩ই জানুয়ারি তিলকা মাজহীর বাটুলের গুলিতে ক্লিভল্যাণ্ড সাহেব আহত হয়ে মারা যান। বাটুল হচ্ছে তীর ধনুকের মতো কিন্তু তীর পরিবর্তে পোড়ামাটির শক্ত গুলি, পাথরের টুকরো অথবা মাছ ধরা জালের লোহার কাঠি ব্যবহার করতো। বন্দুক অথবা রাইফেলের গুলির মতো বাটুলের গুলিও প্রচণ্ড শক্তি ও গতির অধিকারী ছিলো। আধুনিক সমরাস্ত্রে সুশিক্ষিত ইংরেজ বাহিনীর সাথে কতোক্ষণ এ যুদ্ধ চলতে পারে। তিলকপুরের মাটি আদিবাসী সাঁওতালদেও রক্তে লাল হয়ে গেল। তিলকা মাজহী ধরা পড়লেন। তাঁকে ভাগলপুরে নিয়ে এসে নিদারুণ শারিরীক অত্যাচার করা হলো। শেষে ঘোড়ার সাথে বেঁধে সিনেমার স্টাইলে তাকে টেনে হিচড়ে সমস্ত শহর ঘোরানো হলো। এতেও তাঁর মৃত্যু হয়নি দেখে তাঁকে বটগাছে ঝুলিয়ে (১৭৮৫ খ্রিষ্টাব্দে) ফাঁসি দেওয়া হয়। এভাবেই ইতিটানা হয় সাঁওতাল বিদ্রোহের প্রথম পর্ব। [১]




ছবি ১  - সিদু-কানুর আদর্শে উজ্জীবিত সাঁওতাল যুবক

স্বাধীনতা প্রিয় সাঁওতালদের দমন-নিপীড়নের শুরুটা সেই ব্রিটিশদের হাতে এবং আজও চলে আসছে। এই স্বাধীন বাংলাদেশেও চলছে পুরোদমে। অথচ ওরা বঙ্গবন্ধুর ডাকে সাড়া দিয়ে হাতের তীর-ধনুক তুলে নিয়েছিল, এই দেশের স্বাধীনতায় লড়েছিল বাঙালির পাশে। ঐ নিয়েই ২৭-২৮ মার্চ দল বেঁধে আক্রমণ করেন রংপুর ক্যান্টনমেন্ট এবং পাকসেনার গুলিতে অনেকেই শহীদ হন [২]; আমরা ওদের আজও স্বীকৃতি দেই নি।




ছবি ২  - ২৮ মার্চ, ১৯৭১ এ সাঁওতাল-ওঁড়াওঁ-রংপুরি-বাঙালির সম্মিলিতভাবে রংপুর ক্যান্টনমেন্ট আক্রমণ।

১৯৯১ সালের আদমশুমারি অনুসারে বাংলাদেশে সাঁওতালদের মোট সংখ্যা ২০২৭৪৪, ২০১২ সাল নাগাদ ওদের সংখ্যা হয়ে দাঁড়ানোর কথা কমপক্ষে ২৭১৪৮৫; কিন্তু প্রকৃতপক্ষে ওদের সংখ্যা তিন লাখের বেশি হবে। কিন্তু ১৯৪১ সালের ব্রিটিশ ভারতের আদমশুমারি রিপোর্ট দেখলে পাওয়া যায় তখন সাঁওতালদের সংখ্যা ছিল ৮২৯০২৫ জন যার ভেতরে পূর্ব বাংলা তথা বাংলাদেশে সাঁওতাল ছিলো ২৮২৬৮২ জন। অর্থাৎ প্রকৃতপক্ষে সাঁওতাল এর সংখ্যা যেভাবে বাড়ার কথা সেভাবে বাড়ে নি, উল্টো কমেছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে এদের সক্রিয় অংশগ্রহণ থাকলেও স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে ভূমি থেকে উচ্ছেদ, নানা অত্যাচার, শোষণ-নিপীড়ন, হত্যা-ধর্ষণ ইত্যাদি কারণে এরা দলে দলে দেশ ত্যাগে বাধ্য হয় [৩]; এদের অনেকেই চলে গেছে পাশের দেশ ভারতে যেখাতে সাঁওতালদের বর্তমান সংখ্যা ৬ লাখের মতন, আর নেপালে ৫০ হাজারেরও বেশি।

অস্ট্রিক গোষ্ঠির সাথে সাঁওতালদের চেহারায় ব্যাপক মিল আছে। এদের দৈহিক বৈশিষ্ট্য হলঃ খজর্বাকৃতি, মাথার খুলি লম্বা থেকে মাঝারি, নাক চওড়া ও চ্যাপ্টা, গায়ের রঙ কালো এবং ঢেউ খেলানো [৪]; ভাষাগত পরিচয়ে এরা অস্ট্রো-এশিয়াটিক। নৃতাত্ত্বিকদের ধারণা এরা ভারতবর্ষের আদিম অধিবাসীদের অন্যত্ম। এক সময় এরা বাস করতো উত্তর ভারত থেকে শুরু করে প্রশান্ত মহাসাগরের ইস্টার দ্বীপ পর্যন্ত। আনুমানিক ৩০ হাজার বছর পূর্বে এরা ভারত থেকে অস্ট্রেলিয়া গিয়েছিল [৫], আর সাঁওতালরা যে আর্যদের আগে থেকেই ভারতে আছে সে ব্যাপারে কোনই দ্বিমত নেই। এদের আদি নিবাস হয়েছিল হাজারিবাগ, মালভূম (চায়-চাম্পা), এবং বিহারের আশ-পাশের বিভিন্ন অঞ্চল। মোঘল আমলে এরা হাজারীবাগ, মালভূম হতে বিতাড়িত হয়ে ওড়িষ্যার সাঁওতাল পরগণায় চলে আসে।

সাঁওতালরা আজও নিজেদেরকে বলে ‘হোড়’ কিংবা ‘হেড়’ যার অর্থ মানুষ আর ওদের কারমণকারী মানুষদেরকে বলে ‘দিকু’ যার অর্থ আক্রমণকারী কিংবা ডাকাত। ওরা প্রকৃত অর্থেই নিপীড়িত এক গোষ্ঠী। অশিক্ষিত সাঁওতালদের সরলতার সুযোগ নিয়েছে শিক্ষিত ধনীক গোষ্ঠী। জমিদার, মহাজন, প্রশাসক ও স্থানীয় প্রভাবশালী হিন্দু-মুসলমান ওদেরকে করেছে শোষণ আর ইংরেজরা করেছে অত্যাচার। [৬]

সুনীতি কুমারের এক গ্রন্থে পাই,


... ... ... বিহার প্রদেশ বিশেষ করিয়া সাঁওতাল পরগণা উড়িষ্যা, বাংলাদেশ বিশেষ করিয়া পশ্চিম ও উত্তর বঙ্গ, এবং আসাম এই সমস্ত স্থানে সাঁওতালদের বাস। ইহাদের আদি ভূমি হইতেছে বিহারে; উত্তর বঙ্গ ও আসামে মজুরীগিরি করিবার জন্য দলে দলে গিয়া ইহারা বাস করিতেছে। ... ... ... [৭]

বাংলাদেশে সাঁওতালদের আগমন ঘটেছে নানা কারণে। এর মধ্যে জমিদার-মহাজনেরা যেমন তাদের কাজের প্রয়োজনে সাঁওতালদের উত্তরবঙ্গে এনেছেন, তেমনি এরা নিজেরাই জীবিকার সন্ধানে, খাদ্য ও বাসস্থল সংকটে, এমনি কি ১৮৫৫ সালে সাঁওতাল বিদ্রোহের কারণে ইংরেজ কর্তৃক বিতাড়িত হয়ে এ অঞ্চলে বাসস্থান গড়েছে।

Qureshi এর বইতে পাওয়া যায়,


… … … Santals came originally to clear land, build rail roads, and do other labor, and many of them work today as landless, laboures, but some have assets… [৮]

স্বাধীন বাংলাদেশেও ওরা যে কতটা নিপীড়িত তার একটা ছটত উদাহরণ আলফ্রেড সরেন। ১১ বছর আগের এই দিনটাতে ভূমিদস্যু হাতেম আলী ও সীতেশ চন্দ্র ভট্টাচার্য ওরফে গদাই এর ভাড়াটিয়া সন্ত্রাসী বাহিনীর হামলায় আলফ্রেড সরেন নৃশংস ভাবে খুন হন। আদিবাসী নেতা আলফ্রেড সরেন হত্যার ঘটনায় তার ছোট বোন রেবেকো সরেন বাদী হয়ে হত্যা ও জননিরাপত্তা আইনে পৃথক দু’টি মামলা দায়ের করেন। কিন্তু আজও খুনীরা মুক্তভাবে ঘুরে বেড়াচ্ছে, ওদের হুমকির মুখে অনেক সাঁওতালই ধীরে ধীরে আদিবাসী পল্লী ত্যাগ করছে।





ছবি ৩  - ১৮ আগস্ট, ২০০১ সালে বাঙালি ভূমিদস্যুদের আক্রমণে নিহত আদিবাসি নেতা আলফ্রেড সরেন।



২০০০ সালের ১৮ আগস্ট, ঘড়ির কাটায় সকাল এগারটা, ভূমি দস্যু হাতেম ও গদাই লস্কর তার দেড়শতাধিক ভাড়াটিয়া খুনি সন্ত্রাসী বাহিনী নিয়ে নওগাঁ জেলার, মহাদেবপুর উপজেলার ভীমপুর গ্রামের ১৩টি আদিবাসী পরিবারের উপর যে নারকীয় হত্যাযজ্ঞ ও তাণ্ডবলীলা চালায় তা মধ্যযুগীয় বর্বরতাকে হার মানায়। অতর্কিত এই আক্রমণে আদিবাসীরা হত বিহ্বল হয়ে পড়ে। খুনিরা চিৎকার করে খুজতে থাকে আলফ্রেড সরেনকে। একেরপর এক বাড়ী আগুনে জ্বালিয়ে দিতে দিতে অগ্রসর হয় খুনিরা। সামনে যাকে পায় তার উপর চলে পৈশাচিক নির্যাতন। শিশুদের হাত পা ধরে পুকুরে ছুড়ে মারা হয়। আদিবাসী পরিষদের নেতা বৃদ্ধ জগন্নাথ সরেণ ও যতীন সরেণ নামে ৩০ বছরের এক যুবককে আগুনে নিক্ষেপ করা হয়। আলফ্রেড সরেণের বড় ভাইয়ের স্ত্রী পানসিরির পেটে লাথি দেবার ফলে তার গর্ভচ্যুতি ঘটে।

চারিদেকে যখন আদিবাসীদের আত্ম-চিৎকার আর আগুনের লেলিহান শিখায় আকাশ বাসাত ভারি হয়ে উঠেছে, তখন খুনিদের উন্মত্ত খুনের নেশা আলফ্রেড সরেণকে খুজেছে। তখন বোন রেবেকা সরেণ ভাইকে নিয়ে বাঁচার জন্য পাশের বাড়ীতে ঘরের মধ্যে ধানের বস্তার ফাঁকে আশ্রয় নেয়। কিছুক্ষণের মধ্যেই সেই ঘরে আগুন ধরিয়ে দেয় খুনিরা। আগুনের উত্তাপে টিকতে না পেরে  রেবেকা সরেণ ঘরের জানালা ভেঙ্গে ভাইকে সঙ্গে নিয়ে পালানোর চেষ্টা করে। কিন্তু ঘর থেকে বের হওয়া মাত্রই খুনিদের হাতে ধরা পড়ে আলফ্রেড সরেন। খুনিরা রামদা, চাইনিজ, কুড়াল, বল্লম দিয়ে একেরপর এক আঘাত করতে থাকে। মাটিতে লুটিয়ে পড়েন আলফ্রেড সরেণ । আহত অবস্থায় খুনিদের কাছে আকুতি জানায় আমার হাত পা কেটে ফেলো কিন্তু প্রাণে মেরো না আমি কি দোষ করেছি তোমাদের কাছে ? বেঁচে থাকার আকুতি খুনিদের কানে পৌছায় না। আলফ্রেডের আকুতি খুনিদের আরও উন্মত্ত করে তোলে বর্শার ফালার আঘাতে ক্ষত-বিক্ষত আলফ্রেড সরেণ মৃত্যর কোলে ঢলে পড়ে। বোন রেবেকা সরেন মাত্র ৫০গজ দুরে মূর্তিরমত দাড়িয়ে দেখে ভাইয়ের মৃত্যু। আগুনের লেলিহান শিখায় জ্বলে ছাই হয়ে যায় ভীমপুরের আদিবাসী পল্লীর ১৩টি পরিবার। ৩০/৩৫ জান আদিবাসী মারাত্বকভাবে আহত হয়। সকাল ১১টা থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত তিন ঘন্টা ব্যাপি চলে এই নারকীয় হত্যাযজ্ঞ। দীর্ঘ সময় ব্যাপী এই নারকীয় তাণ্ডব চললেও রহস্যজনকভাবে পুলিশ নিরব ও নিস্ক্রিয় ভূমিকা পালন করে।

ভীমপুর গ্রাম ও মৌজার ১৬৬ ও ১৬৮ দাগের এক একর জমির উপর তখন যে ১৩টি আদিবাসী সাঁওতাল পরিবার বসবাস করত। এর অল্প দুরে ৯০/৯৫ বিঘা খাস জমি ছিল। সেই জমি দরিদ্র আদিবাসী ও এলাকার ভূমিহীনদের কাছে বন্দোবস্তো দেবার জন্য আলফ্রেড সরেণ এলাকার ভূমিহীন ও আদিবাসীদের সংগঠিত করে তাদের মাঝে বিতরণ করতে চেয়েছিল। কম্যুনিস্ট পার্টির সক্রিয় সদস্য ও জাতীয় আদিবাসী পরিষদের নওগাঁ জেলার এই নেতাকে ভূমি দস্যু হাতেম গদাই গং ও তার সন্ত্রসী বাহিনীর নির্মমভাবে খুন করে। যে দিন আলফ্রেডকে হত্যা করা হয় সেই দিন স্থানীয় নৈ-হাটা মোড়ে ভূমিহীনদের সমাবেশ হবার কথা ছিল। সকালে ঘুম থেকে উঠে সমাবেশের মঞ্চ তৈরীর কাজ দেখাশুনা করে ১০টা ৩০ মিনিটের দিয়ে বাড়ীতে খেতে আসার পরপরই এই ঘটনা ঘটে। [৯]

দেখতে দেখতে ১১ টা বছর চলে গেল। আলফ্রেড সরেন হত্যার বিচার হয়নি, এর বিচার আদৌ হবে সে আশা করাটাও খুব কঠিন। আজ মৃত কিংবা শহিদ আলফ্রেড সরেন সাঁওতালদের জন্য এক বীরের নাম। আলফ্রেডের নাম উচ্চারিত হয় সিদু-কানুর নামের সাথে। 

আলফ্রেড সরেনের আত্মত্যাগ কি নাড়া দেবে বাঙালিদের?? বাঙালি কি এগিয়ে আসবে আদিবাসি ও অন্যন্যগোষ্ঠী দমন-নিপীড়নের দায় থেকে নিজেদেরকে মুক্ত করতে??

তথ্য-উৎসাবলিঃ
[১] ৩০ শে জুন ইতিহাসের স্মরণীয় সান্তাল (সাঁওতাল) বিদ্রোহ - মিথুশিলাক মুরমু, আদিবাসী বাংলা ব্লগ।
[২] মুক্তিযুদ্ধে রংপুর ক্যান্টনমেন্ট।
[৩] বাংলাদেশের আদিবাসী ভাষা – সৌরভ সিকদার।
[৪] বাঙালি নৃতাত্ত্বিক পরিচয় – ড, অতুল সুর।
[৫] ভারতের নৃতাত্ত্বিক পরিচয় – ড, অতুল সুর।
[৬] সাঁওতাল সমাজ সমীক্ষা – ধনপতি বাগ।
[৭] ভারতের ভাষা ও ভাষা-সমস্যা – সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়।
[৮] Journal: Tribal Cultures in Bangladesh – Shah Qureshi, Institute Of Bangladesh Studies, Rajshahi University.
[৯] আলফ্রেড সরেন মৃত্যু যাকে অমরত্ব দিয়েছে - রানা, উন্মোচন ব্লগ।

চিত্র-উৎসাবলিঃ
[১] গুগল সার্চ।
[২] বাংলাদেশ বার্তা ডট কম।
[৩] দৈনিক কালের কণ্ঠ।

শ্রমিকের কান্না




উৎসর্গঃ শ্রমিকদের রক্তাক্ত, নীথর লাশগুলোকে; রক্তের মাঝেই বেঁচে যাওয়া শ্রমিকের আর্তনাদকে; না খেতে পারা শ্রমিকদের বোবা কান্নাকে।

শ্রমিকের কান্না

'এই বেতনে ঘর চলে না...
চালের দাম বেড়ে গেছে, তেলের দাম বেড়ে গেছে...
ঘরে আমার আধপেটা শিশু, অনাহারী বধূ...
দেও না বাড়িয়ে দু'টো পয়সা...
বেশি না... মাত্র দু'টো পয়সা বাড়ালেই চলবে...'

'চুপ কর! শয়তানের দল!
কী এমন করিস যে তোদের এত খাই খাই??'

'তোমাদের তো কত্ত টাকা...
আর দু'টো পয়সা দিলে ক্ষতি কী??'

'ভিখেরির দল...
তুই কী বুঝিস লাভ আর ক্ষতির??
কথা না বাড়িয়ে কাজে যা...
নয়তো চাবুক বলবে কথা...'

'তোমরা তো থাকো ঐ আরাম-ঘরে,
বুঝবে কেমনে সেই খনির গরম??
কত জ্বলে-পুড়ে টোকাই হীরে...
আর তোমরা তাই বেঁচে পার্টি করো...'

'খামোস!! হারামীর বাচ্চারা!!
একটু পরেই আসবে মালিক,
তাই আর না চেঁচিয়ে কাজে চলে যা...'

'নাহ, এই বেতনে কাজ হবে না...
দু'টো পয়সা বাড়াতেই হবে...'

'কুত্তার দল, কথা না বাড়িয়ে কাজে যা...
মালিক আসবে এক্ষুণি...
কাজে যা নয়তো অ্যাকশন...'

'আমাদের দাবি, আমাদের দাবি...
মানতে হবে, মানতে হবে...
দু'টো পয়সা, দু'টো পয়সা...
বাড়াতে হবে, বাড়াতে হবে...'

'পুলিশ... পুলিশ...
কী দেখছো তাকিয়ে??
অ্যাকশন...'

'অ্যাকশন...'

ঠা... ঠা... ঠা...
ঠা... ঠা... ঠা...
ঠা... ঠা... ঠা...

রক্ত.. রক্ত... আর রক্ত...
রক্তের চোরা স্রোতে ভাসে শ্রমিকের লাশ...
একজন-দু'জন এখনো বেঁচে,
যন্ত্রণায় কাঁতরাচ্ছে, 'একটু জল হবে?? জল??'

ঠা... ঠা... ঠা...

'আ-আ-আ...'

এভাবেই বাড়তে থাকে শ্রমিকের লাশ...
একটা... দু'টো... হাজার... লাখ... কোটি...
আর মালিকেরা আরাম-ঘরে আয়েসে বসে খবর শোনে,
মিডিয়ার বানানো খবরঃ
'অবশেষে শ্রমিকেরা তাদের অন্যায্য দাবি থেকে সরে এসেছে,
কাল থেকে কাজে যোগ দিবে!!'

মঙ্গলবার, ১৪ আগস্ট, ২০১২

সেদিন আকাশে শ্রাবণের মেঘ ছিল, ছিল না চাঁদ...


সেদিন আকাশে শ্রাবণের মেঘ ছিল, ছিল না চাঁদ...
ভোরের আলোয় তোমার রক্ত মুছে গেল সমুদ্র সমতল... [১]

১৫ আগস্ট, ১৯৭৫ এর কাল রাত্রিতে বাংলাদেশের আকাশে চাঁদ দেখা যায় নি। পুরো আকাশ ঢাকা ছিল শ্রাবণের মেঘে। এমন একটা রাতের শেষ ভাগে রক্তনেশায় পাগল খুনীর দল বাঙালি জাতির পিতা, স্বাধীনতার জনক, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যা করে পাল্টে দিয়ে চাইলো সদ্য স্বাধীন অসাম্প্রদায়িক, সমাজতান্ত্রিক বাংলাদেশের চেহারা। খুনীরা শুধু বঙ্গবন্ধুকেই খুন করে নি, খুব করেছে তার গোটা পরিবার, তার আত্মীয়-স্বজন।



ছবিঃ যুবক শেখ মুজিব, ১৯৪৭



ছবিঃ মহত্মা গান্ধীর সাথে বৈঠকে শেখ মুজিব, ১৯৪৭

বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করাটা কোন বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছিলো না। সেদিনের ধানমন্ডি ৩২ এর রক্তবন্যা ছিল কিছু মহলের সুদূর প্রসারী ভাবনার ফসল। এখানে হাত ছিল হেরে যাওয়া চির-কুৎসিত পাকিদের; যার প্রমাণ মেলে মোশতাকের ‘বাংলাদেশ বেতার’-কে ‘রেডিও পাকিস্তান’ এর আদলে ‘রেডিও বাংলাদেশ’ এর ঘোষণায়, বাঙালির প্রাণের শ্লোগান বদলে ‘বাংলাদেশ জিন্দাবাদ’ এর প্রচারে। এর পেছনে হাত ছিল পাকিদের দোসর, রাজাকার, আল-বদর, আল-শামসের তীর্থ জামায়েত ইসলামীদের; যার প্রমাণ মেলে জিয়া সরকারের রাজাক্র বিচার প্রক্রিয়া থামিয়ে দেওয়ার মধ্য দিয়ে, রাজাকারদের রাজনীতিতে পুনর্বাসনের মধ্যদিয়ে। এখানে হাত ছিল তথাকথিত ইসলামপন্থী, মূলত ধর্ম ব্যবসায়ীদের; যার প্রমাণ মেলে জিয়া সরকারের বাংলাদেশ রাষ্ট্রের সুন্নতে খৎনা করে সংবিধানে ‘বিসমিল্লা’ সংযোজনের মধ্য দিয়ে। এখানে হাত ছিল সাম্রাজ্যবাদী, পুঁজিবাদী যুক্তরাষ্ট্রের; যার প্রমাণ মেলে বাংলাদেশ থেকে সমাজতন্ত্র ব্যাপারটিকে মুছে দিয়ে আমাদের সংবিধানে ‘সমাজতন্ত্র’ শব্দকে একটি খেলো শব্দে পরিণত করার মধ্য দিয়ে। এর পেছনে হাত ছিল রাজনীতিকে পুঁজি করে পল্টীবাজ রাজ-বেশ্যাদের, যার প্রমাণ মেলে জিয়ার ‘আমি রাজনীতিবিদদের জন্য রাজনীতিটাকে কঠিন করে দিবো’ বয়ানের মধ্য দিয়ে।



ছবিঃ সপরিবারে শেখ মুজিব



ছবিঃ স্ত্রী শেখ ফজিলাতুন্নেসার সাথে শেখ মুজিব, ১৯৪৭



ছবিঃ কণ্যা শেখ হাসিনার সাথে বঙ্গবন্ধু

খুনীচক্র শুধু বঙ্গন্ধুকে খুন করেই খান্ত হয় নি, বাংলাদেশের বুক থেকে তাঁর নাম চিরতরে মুছে দিতে চেয়েছিল। তাই এক রাতের মাঝেই বাংলাদেশের সকল সরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে বঙ্গবন্ধুর ছবি সরিয়ে ফেলা হয়েছিল। আমাদের ইতিহাস বই থেকে বঙ্গবন্ধুর নাম মুছে দেওয়া হয়েছিল। পাঠবই থেকে পাকবাহিনী নামটা মুছে সেখানে হানাদার বাহিনী লেখা হয়েছিল। রাষ্ট্রের মূলনীতি বদলে ফেলা হয়েছিল। ৭ মার্চের অমর কাব্যের পটভূমি, আমাদের বিজয়ের সাক্ষী রেসকোর্স ময়দানের চেহারা বদলে ফেলা হয়েছিল। উন্মুক্ত উদ্যানে গাছে ভরে হয়ে উঠলো সোহরাওয়ার্দী উদ্যান, শিশুদের জন্য তৈরি হল জিয়া শিশুপার্ক, আর অনেকটায় জায়গায় তৈরি হল সরকারি অফিস। স্বাধীনতার নতুন ঘোষক তৈরি করা হয়েছিল, সেই দাবিকে প্রতিষ্ঠা করবার জন্য সেক্টর কমাণ্ডার, পরবর্তীতে সেনাপ্রধান লে, জেনারেল মীর শওকত এর ড্রামতত্ত্বের আগমন ঘটেছিল।



ছবিঃ ৭ই মার্চ, ১৯৭১ এর বিখ্যাত ভাষণরত বঙ্গবন্ধু

কিন্তু সবাই স্রোতে গা ভাসিয়ে চলে গেলেও কিছু মানুষ স্রোতের বিপরীতে রুখে দাঁড়ায়, ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য সত্যিকারের ইতিহাসটা লিখে রেখে যায় নিজ প্রাণের পরোয়া না করেই। তাদেরই একজন কবি নির্মলেন্দু গুণ। তিনি লিখে রেখেছেন বাঙালির শ্রেষ্ঠ কবিতার কথা, সেই কবিতার কবির কথাঃ

একটি কবিতা লেখা হবে তার জন্য অপেক্ষার উত্তেজনা নিয়ে
লক্ষ লক্ষ উদাত্ত অধীর বিদ্রোহী শ্রোতা বসে আছে
ভোর থেকে জনসমুদ্রের উদ্যান সৈকতে : "কখন আসবে কবি?"
এই শিশুপার্ক সেদিন ছিল না,
এই বৃক্ষে ফুলে শোভিত উদ্যান সেদিন ছিল না,
এই তন্দ্রাচ্ছন্ন বিবর্ণ বিকেল সেদিন ছিল না।
তা হলে কেমন ছিল সেদিনের বেলাটি?
তা হলে কেমন ছিল শিশুপার্কে, বেঞ্চে, বৃক্ষে, ফুলের বাগানে
ঢেকে দেয়া এই ঢাকার হৃদয় মাঠখানি?

জানি, সেদিনের সব স্মৃতি মুছে দিতে হয়েছে উদ্যত
কালো হাত। তাই দেখি কবিহীন এই বিমুখ প্রান্তরে আজ
কবির বিরুদ্ধে কবি,
মাঠের বিরুদ্ধে মাঠ,
বিকেলের বিরুদ্ধে বিকেল,
উদ্যানের বিরুদ্ধে উদ্যান,
মার্চের বিরুদ্ধে মার্চ...

হে অনাগত শিশু, হে আগামী দিনের কবি,
শিশুপার্কের রঙ্গিন দোলনায় দোল খেতে খতে তুমি
একদিন সব জানতে পারবে; আমি তোমাদের কথা ভেবে
লিখে রেখে যাচ্ছি সেই শ্রেষ্ঠ বিকেলের গল্প।
সেদিনের এই উদ্যানের রূপ ছিল ভিন্নতর।
না পার্ক না ফুলের বাগান, -এইসবের কিছুই ছিল না,
শুধু একখন্ড অখন্ড আকাশ যেরকম, সেরকম দিগন্ত প্লাবিত
ধু ধু মাঠ ছিল দুর্বাদলে ঢাকা, সবুজে সবুজময়।
আমাদের স্বাধীনতাপ্রিয় প্রাণের সবুজ এসে মিশেছিল
এই ধু ধু মাঠের সবুজে।

কপালে কব্জিতে লালসালু বেঁধে
এই মাঠে ছুটে এসেছিল কারখানা থেকে লোহার শ্রমিক,
লাঙ্গল জোয়াল কাঁধে এসেছিল ঝাঁক বেঁধে উলঙ্গ কৃষক,
পুলিশের অস্ত্র কেড়ে নিয়ে এসেছিল প্রদীপ্ত যুবক।
হাতের মুঠোয় মৃত্যু, চোখে স্বপ্ন নিয়ে এসেছিল মধ্যবিত্ত,
নিম্ন মধ্যবিত্ত, করুন কেরানী, নারী, বৃদ্ধ, বেশ্যা, ভবঘুরে
আর তোমাদের মতো শিশু পাতা-কুড়ানীরা দল বেঁধে।

একটি কবিতা পড়া হবে,তার জন্য কী ব্যাকুল
প্রতীক্ষা মানুষের : "কখন আসবে কবি? কখন আসবে কবি?"

শত বছরের শত সংগ্রাম শেষে,
রবীন্দ্রনাথের মতো দৃপ্ত পায়ে হেঁটে
অতঃপর কবি এসে জনতার মঞ্চে দাঁড়ালেন।
তখন পলকে দারুন ঝলকে তরীতে উঠিল জল,
হৃদয়ে লাগিল দোলা,জনসমুদ্রে জাগিল জোয়ার
সকল দুয়ার খোলা।কে রোধে তাঁহার বজ্রকন্ঠ বাণী?
গণসুর্য্যের মঞ্চ কাঁপিয়ে কবি শোনালেন তাঁর অমর কবিতাখানি :
"এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম,
এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।"

সেই থেকে স্বাধীনতা শব্দটি আমাদের। [২]

সেই অমরকাব্য টা যদি কেউ না শুনে থাকেন কিংবা আবারো শুনে নিতে চান, শুনে নিনঃ


৭ মার্চ, ১৯৭১ যা বলার বঙ্গবন্ধু বলে গিয়েছেন। এরপর আর আলাদা করে স্বাধীনতা ঘোষণার দরকার পরে না। তারপরও আনুষ্ঠানিকতার জন্য ২৫ মার্চ দিবাগত কাল্‌ রাত্রিতে পাকিস্তান বাহিনীর হাতে গ্রেফতার হবার আগে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করে যান, যার প্রমান মেলে পাকিস্তানি মেজর শালিকের ‘অ্যা উইটনেস টু সারেন্ডার’ বইতে। সেই কাল্‌রাত্রিতে দেওয়া ভাষণের রেকর্ডখানা না পাওয়া গেলেও পরদিন বিশ্বের অনেক দেশের মানুষই তাদের দৈনিক পত্রিকা খুলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দেওয়া ভাষণের খবর পেয়ে যান।



অষ্ট্রেলিয়া: The Age - March 26, 1971 -“Dacca breaks with Pakistan”



আর্জেন্টিনা: Buenos Aires Herald - March 27, 1971 - “Bengali independence declared by Mujib”

বিস্তারিত জানতে চাইলে শ্রদ্ধেয় সহ-ব্লগার যাত্রী-এর '৭১ সালে ৬টি মহাদেশের মিডিয়ায় ২৬শে মার্চের বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষনার খবর পোস্টটা দেখে নিন। এটা দেখার পরেও জ্ঞানাপাপীরা অন্য কাউকেই স্বাধীনতার ঘোষক বলে দাবি করে যাবে।



ছবিঃ পাইপ ঠোঁটে চিন্তিত বঙ্গবন্ধু

নেতা নেই, নেতাকে পাকবাহিনী নিয়ে গেছে সুদূর পশ্চিমে, পাকিস্তানে। তাই বলে কি লড়াই থেমে যাবে?? না, লড়াই থেমে যায় নি। বঙ্গবন্ধুর ছায়া হয়ে থাকা বঙ্গতাজ তাজউদ্দিন আহমদ নেতৃত্ব দিয়ে গেছেন বাংলাদেশের স্বাধীনতার রাজনৈতিক যুদ্ধের। নেতা নেই কিন্তু সেই নেতার নামের সবকিছু পরিচালিত হয়েছে। তাই স্বাধীন বাংলা সরকারের রাষ্ট্রপতি হয়েছেন বঙ্গবন্ধু। তাঁর অনুপস্থিতে সে দায়িত্ব পালন করেছেন বঙ্গবন্ধুর আরেক যোদ্ধা সৈয়দ নজরুল ইসলাম, সাথে ছিলেন ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলী, এ এইচ এম কামরুজ্জামান। সামরিক নেতৃত্ব দিয়ে গেছেন অবসরপ্রাপ্ত কর্নেল আতাউল গণি ওসমানী। নেতা না থাকলেও নেতার নামে ঝাঁপিয়ে পড়েছে বাংলার মানুষ। এক মুজিব না থাকলে, লক্ষ তরুণ মুজিব ঝাঁপিয়ে পড়েছে মুক্তির রণে।



ছবিঃ চির-উজ্জ্বল বঙ্গবন্ধু

শোন একটি মুজিবরের থেকে
লক্ষ মুজিবরের কন্ঠস্বরের ধ্বনি-প্রতিধ্বনি
আকাশে বাতাসে ওঠে রণী
বাংলাদেশ, আমার বাংলাদেশ।।

এই সবুজের বুকে চেরা মেঠো পথে
আবার যে যাব ফিরে, আমার
হারানো বাংলাকে আবার তো ফিরে পাব
শিল্পে-কাব্যে কোথায় আছে
হায়রে এমন সোনার খনি।।

বিশ্ব কবির ‘সোনার বাংলা’,
নজরুলের ‘বাংলাদেশ’,
জীবনানন্দের ‘রূপসী বাংলা’
রূপের যে তার নেই কো শেষ, বাংলাদেশ।

জয় বাংলা বলতে মন রে আমার
এখনও কেন ভাবো আবার
হারানো বাংলাকে আবার তো ফিরে পাব
অন্ধকারে পূর্বাকাশে-, উঠবে আবার দিনমণি।। [৩]

পাকিস্তানি সরকার বঙ্গবন্ধুকে এক গোপন কুঠুরীতে লুকিয়ে রাখলো। গোপনে সাজানো বিচার চলতে লাগলো। বিচারে তাঁর মৃত্যদণ্ড হল। তাঁর ফাঁসির প্রস্তুতি চলতে থাকলো, কবরও খোঁড়া হল। কিন্তু বিশ্বজনমত উপেক্ষা করে পাক সকরকার এইকাজ করতে পারলো না। আর সময়ের সাথে সাথে ৩০ লাখ কিংবা তারও অধিক বাঙালির রক্ত, ২-৪ লাখ মা-বোনের সম্মানের বিনিময়ে এল স্বাধীনতা। পাক সরকার বঙ্গবন্ধুকে ছেড়ে দিতে বাধ্য হলেন। তিনি লন্ডন হয়ে দেশে ফিরলেন ২০ জানুয়ারি, ১৯৭২। আবেগে আপ্লুত হয়ে বিমানবন্দরে জনসমাবেশে চোখের জলে ভাসলেন, ফুলের মালায় ভাসলেন, আর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতা উদ্ধৃত করে বললেনঃ

...... কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, ‘সাত কোটি বাঙালেরে হে বঙ্গ জননী রেখেছো বাঙালি করে, মানুষ করে যাও নি’... কবিগুরুর কথা মিথ্যা প্রমাণ হয়ে গেছে। আমার বাঙালি আজ মানুষ... ......


কবিগুরুর কথা মিথ্যে হয় নি, পরবর্তীতে সত্যি বলেই প্রমাণিত হয়েছে। বাঙালির সাথে মিশে গেছে দূষিত বাং-পাকিরা। তারা গোপনে নানা ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয় স্বাধীন বাংলাদেশে মুজিব সরকারকে উৎখাত করতে। এর সাথে সামিল হয় মুজিব সরকারের কাল্‌সাপ খন্দকার মোশতাকের মতন কিছু লোক। আর তাদেরকে ব্যবহার করেছে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক চক্র। বঙ্গবন্ধু যখন যুদ্ধে বিধ্বস্ত একটা দেশকে নতুনভাবে গড়ে তুলতে ব্যস্ত তখন আন্তর্জাতিকচক্র আমাদের প্রতিশ্রুতি দিয়েও চাল পাঠালো না। এই ঘটনা ছাড়াও নানা ব্যর্থতায় দেশে নেমে এলো দুর্ভিক্ষ। কালোবাজারীদের দৌড়াত্ব পৌঁছালো চরমে। বাম নামধারী কিছু সন্ত্রাসী দেশে অরাজকতা চালাতে চাইলো। মুক্তিযোদ্ধা নামের কিছু সুবধাবাদী অস্ত্রের জোরে ঘটিয়ে চললো নানা অপকর্ম। এরই মাঝে সেনা বাহিনীকেও উসকানোর কাজে নিয়োজিত কিছু লোক। বঙ্গবন্ধু সবদিক বিবেচনা করে সমাজতন্ত্রের নতুন ধারার সূচনা করতে চললেন ‘বাকশাল’ এর নামে। এর সূচনালগ্নে, আর ভারতের স্বাধীনতা দিবস্কে বেছে নিয়ে ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট থেকে ট্যাঙ্ক নামলো রাস্তায়। ভোরের সূর্য ওঠার আগেই রক্তে ভেসে গেল ধানমন্ডি ৩২ এ বঙ্গবন্ধুর বাড়ি। পুরো পরিবারকে হত্যা করা হল।

পিতা...

পিতা শুধু দেয় নি পরিচয় এক কিংবা দু’টি মানুষকে,
দিয়েছি পরিচয় গোটা জাতিকে।
বুক চিতিয়ে দেখিয়েছে স্বপ্ন মুক্তির, স্বাধীনতার।
জনসমুদ্রে বজ্রনাদের আবৃত্তি করেছে অমর কাব্য,
‘এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম...
এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম...’,
যার অপেক্ষায় ছিল সাড়ে সাত কোটি বাঙালি।

তোমরা সেই পিতাকে করেছো হত্যা।
পুঁজিবাদী আর সাম্রাজ্যবাদী কর্পোরেট আমেরিকা,
গোটা দুনিয়ার দুর্গন্ধ, নাপাকির দল,
আর ইসলামের নাম ভাঙানো শকুনের দল,
হত্যা করলে একটা মানুষ,
হত্যা করলে আমার পিতা,
হত্যা করলে সাড়ে সাত কোটি বাঙালির পিতা...

তোমাদের ছেঁটানো ভাতে উল্লসিত কুৎসিত কাকেরা
রক্তে রাঙালো ধানমন্ডি বত্রিশ...
পিতা আছে সিঁড়িতে শুয়ে,
আর বাকিরা মৃত্য-ঘুমে এখানে-ওখানে...
পিতার বুক হতে ফোঁটায় ফোঁটায় রক্ত গড়িয়ে গেল সিঁড়িতে,
আর কুৎসিত কাকের বুট চলে গেল সে রক্ত মাড়িয়ে...
ট্যাঙ্ক নিয়ে দাপালো শহর...
পিতা, তুমি এই বাংলাকে সব দিয়ে গেলে...
শরীরের রক্তটাও দিয়ে গেলে এই মাটির ‘পরে...

পরে র’লো পিতার নীথর দেহ,
আর আমরা, তোমার সন্তানেরা, তোমাকে শেষবারের মতন দেখতে পারলাম না।
ঘরে দোর দিয়ে কাঁদলাম,
শোকে পাথর হলাম।
আর সব দেখে গেলো ইতিহাসের পাতা।

কী দোষ ছিল আমার পিতার??
তাঁর দোষ ছিল তিনি আমাদের স্বাধীনতা দিয়েছেন,
তাঁড় দোষ ছিল তিনি আমাদের মুক্তির স্বপ্ন দেখিয়েছেন,
পুঁজিবাদকে ঝেটিয়ে এনেছেন সমাজতন্ত্র,
তিনি মাথায় তুলে নাচেন নি সেনাদের,
তাঁর কাছে জায়গা মেলে নি ইসলামের নাম ভাঙানো বেশ্যাপুত্রদের...

তোমরা, আমার পিতাকে হত্যা করলে,
হত্যা করলে এক মানুষ নামের মহামানব মুজিবকে।
কিন্তু মনে রেখো, মুজিবেরা কখনো মরে না,
মুজিবেরা জেগে থাকে অমর হয়ে,
কোটি তরুণের বুকের স্বপ্নে,
রক্তে মেশা মুক্তির নেশায়...

ঐ শোনা লাখোকণ্ঠে প্রিয় মুজিবের ধ্বনি,
আজ আকাশে-বাতাসে ওঠে রণী
ঐ শোনা যায় প্রিয় মুজিবের ‘জয় বাংলা’র প্রতিধ্বনি...

দেবাশিস্‌ মুখার্জি
১৪ আগস্ট, ২০১২



ছবিঃ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান

বঙ্গবন্ধু এক অমর নাম। এই নাম কখনো মুছে দেওয়া যাবে না। এই নাম ধ্রুবতারাসম জ্বলে র’বে সকল বাঙালির বুকে। জ্বলে র’বে অন্তত ততদিন, যতদিন রবে এই বাংলা, যতদিন র’বে পদ্মা, মেঘনা, যমুনা, গৌরী।

যতদিন রবে পদ্মা, যমুনা, গৌরি, মেঘনা বহমান,
ততদিন রবে কীর্তি তোমার, শেখ মুজিবুর রহমান।
দিকে দিকে আজ রক্তগঙ্গা, অশ্রুগঙ্গা বহমান,
তবু নাহি ভয়, হবে হবে জয়, জয় মুজিবুর রহমান।

তথ্য উৎসাবলিঃ
[১] ‘সেদিন আকাশে শ্রাবণের মেঘ ছিল, ছিল না চাঁদ...’-গানের কথা। গানটির গীতিকারঃ অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ এবং সুরকার সাদী মহম্মদ।
[২] একটি কবিতা লেখা হবে – কবি নির্মলেন্দু গুণ।
[৩] ‘স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র’-এর জনপ্রিয় গান ‘শোন একটি মুজিবরের থেকে’-গান এর কথা। গানটির গীতিকারঃ গৌরী প্রসন্ন মজুমদার এবং সুরকার অংশুমান রায়।
[৪] শেখ মুজিবুর রহমান - কবি অন্নদাশঙ্কর রায়।

চিত্র উৎসাবলিঃ
বঙ্গবন্ধুর লেখা 'অসামাপ্ত আত্মজীবনী' এবং গুগল সার্চ।


মঙ্গলবার, ৭ আগস্ট, ২০১২

রবীন্দ্রনাথের মহাপ্রয়াণ




প্রিয়ারে বেসেছি ভালো ,
বেসেছি ফুলের মঞ্জরিকে ;
করেছে সে অন্তরতম
পরশ করেছে যারে। [১]

এই পোস্টটা সেই প্রিয়াকে উৎসর্গ করলাম যে আমাকে ভালোবাসুক কিংবা না বাসুক আমার ভালোবাসার রবীন্দ্রনাথকে ভালোবাসে, সেই প্রিয়াকে উৎসর্গ করলাম যার প্রেমে পড়তে গিয়ে রবীন্দ্রনাথের প্রেমে মজেছিলাম নতুন করে।


মরণসাগরপারে তোমরা অমর,
তোমাদের স্মরি।
নিখিলে রচিয়া গেলে আপনারই ঘর
তোমাদের স্মরি।
সংসারে জ্বেলে গেলে যে নব আলোক
জয় হোক, জয় হোক, তারি জয় হোক—
তোমাদের স্মরি।
বন্দীদের দিয়ে গেছ মুক্তির সুধা,
তোমাদের স্মরি।
সত্যের বরমালে সাজালে বসুধা,
তোমাদের স্মরি।
রেখে গেলে বাণী সে যে অভয় অশোক,
জয় হোক, জয় হোক, তারি জয় হোক—
তোমাদের স্মরি। [২]

আমার কাছে এই কবিতার মানে 'তোমরা'-তে বিস্তৃত না, এর বিস্তৃতি শুধুই 'তুমি'-তে, আর সেই 'তুমি' হলেন আমার    প্রাণের ঠাকুর, আমার প্রিয় বুড়ো কবি, আমার ভাবনার অবিচ্ছেদ্য অংশ, আমার রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। আজ রবি ঠাকুরের মহাপ্রয়াণ দিবস। আজকে যে সময়ে আমি এই লেখাটা লিখে যাচ্ছি তখন আকাশ কাঁদছে শ্রাবণের ধারায়। আকাশ কেন কাঁদছে তা আকাশই জানে। হয়তো ঠাকুরের স্মরণে, হয়তো রক্তাক্ত আগস্টের শোকে, হয়তো বা এ শুধুই এক সাধারণ শ্রাবণধারা।

কবি বিহারীলাল চক্রবর্তীর একনিষ্ঠ ভক্ত রবি নিজ কাব্যের ব্যাপারে ছিলেন কিঞ্চিৎ সন্দিহান। ভেবেছিলেন লোকে কি এসব পড়বে কিংবা পড়েইবা ভাববে কীসব। তাই আর নিজের নামে লেখেন নি, যাত্রা শুরু করে ভানুসিং ঠাকুর নামে। কিন্তু সময়ের সাথে সেই নিজের ওপর বিশ্বাস না পাওয়া ছোঁকড়াই পরবর্তীতে হয়েছেন কাব্যমহীরূহ। যাঁর ছায়ার নীচে আমরা পাই শান্তির পরশ, প্রেমের দোলা, স্বাধিকার আহ্ববান, মুক্তির ডাক, ঈশ্বরের স্বরূপ। ছোঁকড়া থেকে আমার বুড়ো কবি হয়ে ওঠা এই লোকটা শুধু আমারই মন কাড়েন নি, কেড়েছেন সকল বাঙালির, বিশ্ববাসীর।




আমরা বাঙালিরা রোজ ভাত খেয়ে থাকি। কিন্তু ক'জনে খবর নিয়েছি কে সেই সোনার ফসলের জোগানদাতা! আমরা নেই না সেই খবর। একই রকম ভাবে কোন একটা ভালো কাজের ফলটা আমরা বয়ে চলি, কাজটা জায়গা করে নেয় মহাকালের উঠোনে। কিন্তু কাজের কাজীকে ক'জনেই বা চিনতে চায় কিংবা চিনেও মনে রাখে। একইভাবে রবীন্দ্র ঠাকুর নিজেই সংশয় প্রকাশ করে গিয়েছেন যে, লোকে তাঁর কাব্যফসল ঠিকই ঘরে তুলে নেবে, কিন্তু তাঁর তো আর লোকের ঘরে থাকা হবে না।


আমি শীত গ্রীষ্ম বর্ষা মানি নি, কতবার সমস্ত বৎসর ধরে পদ্মার আতিথ্য নিয়েছি, বৈশাখের খররৌদ্রতাপে, শ্রাবণের মুষলধারাবর্ষণে। পরপারে ছিল ছায়াঘন পল্লীর শ্যামশ্রী, এ পারে ছিল বালুচরের পাণ্ডুবর্ণ জনহীনতা, মাঝখানে পদ্মার চলমান স্রোতের পটে বুলিয়ে চলেছে দ্যুলোকের শিল্পী প্রহরে প্রহরে নানাবর্ণের আলোছায়ার তুলি। এইখানে নির্জন-সজনের নিত্যসংগম চলেছিল আমার জীবনে। অহরহ সুখদুঃখের বাণী নিয়ে মানুষের জীবনধারার বিচিত্র কলবর এসে পৌঁচচ্ছিল আমার হৃদয়ে। মানুষের পরিচয় খুব কাছে এসে আমার মনকে জাগিয়ে রেখেছিল। তাদের জন্য চিন্তা করেছি, কাজ করেছি, কর্তব্যের নানা সংকল্প বেঁধে তুলেছি, সেই সংকল্পের সূত্র আজও বিচ্ছিন্ন হয় নি আমার চিন্তায়। সেই মানুষের সংস্পর্শেই সাহিত্যের পথ এবং কর্মের পথ পাশাপাশি প্রসারিত হতে আরম্ভ হল আমার জীবনে। আমার বুদ্ধি এবং কল্পনা এবং ইচ্ছাকে উন্মুখ করে তুলেছিল এই সময়কার প্রবর্তনা— বিশ্বপ্রকৃতি এবং মানবলোকের মধ্যে নিত্যসচল অভিজ্ঞতার প্রবর্তনা। এই সময়কার প্রথম কাব্যের ফসল ভরা হয়েছিল সোনার তরীতে। তখনই সংশয় প্রকাশ করেছি, এ তরী নিঃশেষে আমার ফসল তুলে নেবে কিন্তু আমাকে নেবে কি। [৩]


ঠাঁই নাই, ঠাঁই নাই— ছোটো সে তরী
আমারি সোনার ধানে গিয়েছে ভরি।
শ্রাবণগগন ঘিরে
ঘন মেঘ ঘুরে ফিরে,
শূন্য নদীর তীরে
রহিনু পড়ি—
যাহা ছিল নিয়ে গেল সোনার তরী। [৪]

মহাকাল রূপ সোনার তরী ঠাকুরের সব সোনার ফসল তুলে রেখেছে, যা আমরা আজও ভোগ করে চলেছি। ঠাকুরের কাব্যসুধা আমাদের আন্দোলিত করে প্রতিনিয়ত। কবির ফসল চির অমর, চির সবুজ, সকল কালের, সকল বয়সের। কিন্তু ব্যক্তি কবি অমর হতে পারেন নি। তাঁকে দেহ ত্যাগ করতে হয়েছে সময়েরই সাথে। তাঁর নশ্বর দেহ অমর হতে পারে নি, কিন্তু ঠাকুর আর তাঁর সৃষ্টি কর্ম অমর হয়ে আছে বাঙালির বুকে, বিশ্ববাসীর মনে।

শেষ বয়সে এসে কবি তাঁর পরপারের ডাক স্পষ্টভাবে শুনতে পাচ্ছিলেন আর সে কথা তিনি তার কাব্যে প্রকাশ করে গিয়েছিলেন। এর একটা নমুনা খুঁজে পাওয়া যায় কবির আশি বছর পুর্ণ হবার ক্ষণে লিখে যাওয়া এক অমর কবিতাতে। কবিতাটিতে তাঁর নিজ জীবন নিয়ে চিন্তাধারাটা স্পষ্টরূপে ধরা দেয়ঃ


জীবনের আশি বর্ষে প্রবেশিনু যবে
এ বিস্ময় মনে আজ জাগে—
লক্ষকোটি নক্ষত্রের
অগ্নিনির্ঝরের যেথা নিঃশব্দ জ্যোতির বন্যাধারা
ছুটেছে অচিন্ত্য বেগে নিরুদ্দেশ শূন্যতা প্লাবিয়া
দিকে দিকে,
তমোঘন অন্তহীন সেই আকাশের বক্ষস্তলে
অকস্মাৎ করেছি উত্থান
অসীম সৃষ্টির যজ্ঞে মুহূর্তের স্ফুলিঙ্গের মতো
ধারাবাহী শতাব্দীর ইতিহাসে।
এসেছি সে পৃথিবীতে যেথা কল্প কল্প ধরি
প্রাণপঙ্ক সমুদ্রের গর্ভ হতে উঠি
জড়ের বিরাট অঙ্কতলে
উদ্‌ঘাটিল আপনার নিগূঢ় আশ্চর্য পরিচয়
শাখায়িত রূপে রূপান্তরে।
অসম্পূর্ণ অস্তিত্বের মোহাবিষ্ট প্রদোষের ছায়া
আচ্ছন্ন করিয়া ছিল পশুলোক দীর্ঘ যুগ ধরি;
কাহার একাগ্র প্রতীক্ষায়
অসংখ্য দিবসরাত্রি-অবসানে
মন্থরগমনে এল
মানুষ প্রাণের রঙ্গভূমে;
নূতন নূতন দীপ একে একে উঠিতেছে জ্বলে,
নূতন নূতন অর্থ লভিতেছে বাণী;
অপূর্ব আলোকে
মানুষ দেখিছে তার অপরূপ ভবিষ্যের রূপ,
পৃথিবীর নাট্যমঞ্চে
অঙ্কে অঙ্কে চৈতন্যের ধীরে ধীরে প্রকাশের পালা —
আমি সে নাট্যের পাত্রদলে
পরিয়াছি সাজ।
আমারো আহ্বান ছিল যবনিকা সরাবার কাজে,
এ আমার পরম বিস্ময়।
সাবিত্রী পৃথিবী এই, আত্মার এ মর্তনিকেতন,
আপনার চতুর্দিকে আকাশে আলোকে সমীরণে
ভূমিতলে সমুদ্রে পর্বতে
কী গূঢ় সংকল্প বহি করিতেছে সূর্যপ্রদক্ষিণ —
সে রহস্যসূত্রে গাঁথা এসেছিনু আশি বর্ষ আগে,
চলে যাব কয় বর্ষ পরে। [৫]

জীবনের সায়াহ্নে পৌঁছে চলে যাওয়ার ডাক পাওয়ার কথা তাঁর 'জন্মদিনে' কাব্যগ্রন্থের অন্যান্য জায়গাতেও প্রকাশ পেয়েছে। যেখানে কবি অত্যন্ত বিনয়ের সাথেই প্রকাশ করেছেন, যে মাটি হতে তাঁর শুরু সেমাটিতেই তাঁকে ফেরত যেতে হবে। মানবদেহ ত্যাগ করে কালের মৃত্যু অন্ধকারে তাঁকে হারিয়ে যেতে হবে।


ফসল গিয়েছে পেকে,
দিনান্ত আপন চিহ্ন দিল তারে পাণ্ডূর আভায়।
আলোকের ঊর্ধ্বসভা হতে
আসন পড়িছে নুয়ে ভূতলের পানে।
যে মাটির উদ্‌বোধন বাণী
জাগায়েছে তারে একদিন,
শোনো আজি তাহারই আহ্বান
আসন্ন রাত্রির অন্ধকারে।
সে মাটির কোল হতে যে দান নিয়েছে এতকাল
তার চেয়ে বেশি প্রাণ কোথাও কি হবে ফিরে দেওয়া
কোনো নব জন্মদিনে নব সূর্যোদয়ে! [৬]

যাবার সময়ে নিজেই বলে গেছেন তাঁর সময় হয়েছে কিন্তু তিনি জ্বলে রইবেন ধ্রুবতারাসম। সত্যিই আমার বুড়ো কবিটা এখনো জ্বলজ্বল করছে ধ্রুবতারাসম। তাঁর আলোর কোন ক্ষয় নেই। এ অক্ষয়, এ অবিনশ্বর।


সমুখে শান্তিপারাবার ,
ভাসাও তরণী হে কর্ণধার।
তুমি হবে চিরসাথি ,
লও লও হে ক্রোড় পাতি ,
অসীমের পথে জ্বলিবে জ্যোতি
ধ্রুবতারকার।

মুক্তিদাতা , তোমার ক্ষমা , তোমার দয়া
হবে চিরপাথেয় চিরযাত্রার।

হয় যেন মর্ত্যের বন্ধন ক্ষয় ,
বিরাট বিশ্ব বাহু মেলি লয় ,
পায় অন্তরে নির্ভয় পরিচয়
মহা-অজানার। [৭]

ইশ, যদি আমার জন্মটা হতো আগে, যদি দেখতে পেতাম তাঁকে। জীবনের বড় একটা আক্ষেপ কেন আমি কবিকে দেখতে পারি নি, তাঁর পা ছুঁয়ে শ্রদ্ধা জানাতে পারি নি -  এ সাধ আর মিটবার নয়। আমরা আর কখনই কবিকে খুঁজে পাবো না, যতই শোকময় হয়ে, সকরুণভাবে কাঁদি না কেন। আমরা রয়ে আছি মনিবহারা কুকুরের মতন। আমরা শুধু মনিবের ফেলে চৌকিসম সাহিত্যসুধা পান করে মনের পিয়াস মেটাতে পারি।


কুকুর মনিবহারা যেমন করুণ চোখে চায়
অবুঝ মনের ব্যথা করে হায় হায় ;
কী হল যে , কেন হল , কিছু নাহি বোঝে —
দিনরাত ব্যর্থ চোখে চারি দিকে খোঁজে।
চৌকির ভাষা যেন আরো বেশি করুণ কাতর ,
শূন্যতার মূক ব্যথা ব্যাপ্ত করে প্রিয়হীন ঘর। [৮]

৬ আগস্ট, ২০১২
দেবাশিস্‌ মুখার্জি

তথ্যসূত্রাবলিঃ

[১] শেষ লেখা - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। প্রকাশকালঃ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মৃত্যুর পর, ১৯৪১ খ্রীষ্টাব্দ।
[২] মরণসাগরপারে তোমরা,গীতবিতান - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। প্রকাশ কালঃ জ্যৈষ্ঠ, ১৩৩৩ বঙ্গাব্দ।
[৩] ভূমিকা, সোনার তরী - রবীন্দ্রনাথঠাকুর। ভুমিকা সংযোজন কালঃ বৈশাখ, ১৩৪৭ বঙ্গাব্দ।
[৪] সোনার তরী, সোনার তরী - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। প্রকাশ কালঃ ১৩০০ বঙ্গাব্দ।
[৫] জীবনের আশি বর্ষে প্রবেশিনু যবে, জন্মদিনে - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। প্রকাশ কালঃ ১৩৪৭ বঙ্গাব্দ।
[৬] ফসল গিয়েছে পেকে, জন্মদিনে - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। প্রকাশ কালঃ ১৩৪৭ বঙ্গাব্দ।
[৭], [৮] শেষ লেখা - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। প্রকাশকালঃ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মৃত্যুর পর, ১৯৪১ খ্রীষ্টাব্দ।

চিত্রউৎসাবলিঃ ভারতীয় পুরোনো ছবির সাইট।

সোমবার, ৬ আগস্ট, ২০১২

বন্ধু...

কথা নয় মুখে মুখে,
কথা হবে মনে মনে।
দূরে- কাছে যত বন্ধু আছে,
কথা হবে তোমার সনে...
‍‍‍[জেমসের গান 'কথা হবে']

এই পোস্টটা আমার দূরে-কাছে যত বন্ধু আছে, যারা একদিন বন্ধু ছিল, যারা একদিন বন্ধু হবে তাদের সবাইকে উৎসর্গ করলাম।




বন্ধু, রহো রহো সাথে
আজি এ সঘন শ্রাবণপাতে।
ছিলে কি মোর স্বপনে সাথিহারা রাতে?
বন্ধু, বেলা বৃথা যায় রে
আজি এ বাদলে আকুল হাওয়ায় রে --
কথা কও মোর হৃদয়ে, হাত রাখো হাতে।
[রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর]


বন্ধুত্ব দিবস নিয়ে মাথা ব্যথা নেই কিন্তু বন্ধু নিয়ে আছে। বন্ধুর সাথে সম্পর্ক, চির সবুজ বন্ধুত্ব, কোন একটা নির্দিষ্ট দিনের ধরা-বাঁধা কিছু নয়। বন্ধুত্ব প্রতি দিনের, বন্ধুত্ব চির সবুজ, বন্ধুত্ব অবিচ্ছেদ্য। আমি গা ভাসাই আর না ভাসাই কর্পোরেটের কল্যাণে, উৎসব উদযাপনের ইচ্ছেয়, উপহার-কার্ড-ফুল বিক্রির জোয়ারে অনেকেই গা ভাসায়, আর সে স্রোতের কিছুটা আমাকেও ছুঁয়ে যায়।

প্রতি বছরের আগস্টের প্রথম রবিবারটা আমার জন্য বিশেষ কিছুই ছিলো না, শৈশবে-কৈশরে কখনো এই নিয়ে ভাবিও নি ভালো করে। কৈশরের শেষভাগে এসে প্রাণের জোয়ারে, প্রেমের জোয়ারে বুঝতে হয়েছে এই বিশেষ দিবসের বিশেষত্ব। সেই থেকে কেন যেন এই দিনটা নানাভাবে আমার মনে দাগ কেটে গেছে। কখনো ভালো কিছু স্মৃতি, কখনো দুঃসহ বেদনা দাগ কেটে গেছে। এই বিশেষ দিনটাতেই ভালোবাসার মানুষটাকে অন্য বন্ধুদের সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলাম, বন্ধুত্বের জোয়রে সবাই একসাথে ভাসতে চেয়েছিলাম। আবার কয়েক বছর বাদে ঠিক এই বিশেষ দিনেই পেয়েছি সবচেয়ে বিশ্বস্ত মানুষের কাছ থেকে অবিশ্বাসের দুর্বিসহ যন্ত্রণা, সুন্দর একটা সম্পর্ক ভেঙে যাবার আগমনী বার্তা। আবার গেল বছর আমার পাথর হৃদয়ে ঘাস ফুল ফোঁটাতে এসেছিল একজন, সাথে ছিল বন্ধুত্বের ডালাঃ 'প্রতিদিন বন্ধুত্বের দিন', ভার্চুয়াল থেকে রিয়েল হবার আমন্ত্রণ। সে হৃদয়ে ঢুকেছে, হৃদয়ে থেকেছে, আবার ঐ হৃদয়কেই ভেঙেচূড়ে বিদায় নিয়েছে সময়েরই স্রোতে।

বন্ধুত্ব কী তা বোঝার আগেই বন্ধু পেয়েছি। আমার বয়স যখন মোটে পাঁচ, তখন পড়তে গিয়েছিলাম একটা স্কুলে। বাবা-মায়ের উদ্দেশ্য ছিল মূল স্কুলে ভর্তি হবার আগেই স্কুল জীবনের বিভিন্ন ব্যাপার সম্পর্কে ধারণা লাভ করা। সেখানে একটা ছেলে ছিল যে রোজ আমার সাথে বসতো। ওর চেহারা মনে নেই, নামটাও মনে নেই। শুধু মনে আছে ও আমাকে দোস্ত ছাড়া আর কিছু বলতো না, একসাথে বসতাম, এক আরেক-জনের সাথে বাটার বন কিংবা রিং চিপস্‌ শেয়ার করতাম।

প্রথম সরকারি স্কুলের বিশেষ কারো কথা আমার মনে নেই, শুধু মনে আছে চলে যাওয়াদের দেশে হারিয়ে যাওয়া আমার চিরবন্ধু দিদিমার কথা। দিদিমাই আমাকে প্রতিদিন আনা-নেওয়া করতো। সেই দিদিমার সাথে কত দুষ্টুমি করতাম। স্কুল শেষে পালিয়ে থেকে দিদিমাকে কাঁদাতাম, পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে মুখের হাসি ফিরিয়ে আনতাম, ফিরবার পথে গল্প শুনতাম, রাতে ঘুমোনোর আগে গল্প শুনতাম। আরেকটা ছেলের কথা আবছা মনে পড়ে যার সাথে টিফিন ব্রেকে স্কুলের ভাঙা গাড়িতে উঠে গাড়ি চালানো খেলা খেলতাম, পালা করে হতাম ড্রাইভার-হেল্পার।

দ্বিতীয় সরকারি স্কুলের প্রথম দিনেই বাবা ক্লাশে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল এক ছেলের সাথে, ওকে সবাই ভুট্টুমামা নামে ডাকতো। স্কুলের প্রথম দিনেই শেষ ক্লাশের আগেই পালিয়ে ছিলাম। স্কুলের একমাত্র ফুল বাগানে দু'জনে মিলে ফুল ছিঁড়ছিলাম আর ধরা খেয়েছিলাম নিজের বাবার কাছে। সেই কান মলুনির কথা আজও ভুলি নি। এই স্কুলেই পেয়েছি কাছের বন্ধুদের। স্কুলের ক্লাশ রুম, বরফ-পানি খেলার সিন্ডিকেট নেতা হওয়া, তিনজনে মিলে কোন একটা অঙ্কের সমাধান দাঁড় করানো, মুরগি-দৈত্য-প্রিজমের মতন সাথী পাওয়া, কিংবা নেতা ফরহাদ, কাপ্তান রোমেল, মাঠের বলদ, চোরা মারুফ, ট্যাং বাবা মকি, লাজুক রাহাত, পর্ন ব্যবসায়ী বেজী, ক্লাশ পালানো, আগ্রণীর পুকুরে আড্ডা, আজিমপুরে স্যারের বাসায় প্রেমের জাগরণ, কিংবা উদয়নে এসে আড্ডা, টাংকি মারা - কোন কিছুই কখনো মুছে যাবে না এই মন থেকে। চির সবুজ বন্ধুত্ব, চির দিনকার বন্ধুত্ব আর তার স্মৃতি।

প্রথম কলেজে অনেক নতুন মানুষ দেখলাম, দ্বিতীয় কলেজেও তাই। অনেক অনেক মানূষ দেখেছি, কথা বলেছি কিন্তু আপন করে পেয়েছিন হাতে গুণে ২-৪ জন। রিম্মি-স্নিগ্ধা-সৌরভ এর সাথে দোস্তিটা একটু বেশিই গাঢ় ছিল, কারণ ওরাই ছিল আমার প্রেমের সহায়ক! প্রেমের কারণে কলেজ পর্যন্ত বদলেছিলাম। তাই হারিয়ে ছিলাম অনেককেই। তবে আশা নামের এক মিষ্টি বন্ধুর কথা ভোলা সম্ভব না, পারবোও না কখনো।

প্রথম বিশ্ববিদ্যালয়ের দিন মানেই শুধুই খেলার মাঠ। জাহাঙ্গীর নগরের খেলার মাঠটা সত্যিই দারুন ছিলো। সাথে ছিলো শীতের পাখি দেখা, টঙ্‌ ঘরের সিঙাড়া-চা, বড় ভাইয়াদের র‍্যাগিং প্রচেষ্টা। ওখানে কারো সাথে বন্ধুত্ব না হলেও ৩ টা ছেলে আর একটা পাগলী মেয়ের সাথে কিছুটা সখ্যতা হয়েছিল। দ্বিতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে আসতে আসতে অনেকেই অনেক এগিয়ে গেছে তাই তাল মেলাতে পারছিলাম না। অনেকটা সময় পরে এসে একঝাঁক ছেলে-মেয়েকে পেয়েছিলাম অনেক আপন করে। আইরিনা, নিশিন্দা, মাহি, সুমিত, কৃতী, লিজা, শাকিল, তপু, শাহেদ, নীল, এরিক, পিঙ্কি, আরমান, প্রিয়ম, নাবিলা, রিফাতসহ আরো অনেকে। তবে তপু আর শাহেদের মতন এত ভালো ছেলে আমি খুব কমই দেখেছি।

সময়ের সাথে সাথে কত বন্ধু হারিয়ে গেলো, কত নতুন এলো, তবে কিছু নাম থাকে চির অম্লান। কখনো কখনো মনে হয়েছে আমি বুঝি সত্যিই খুব একা, ওরকম সময়ে একাকিত্বকে ঘুঁচিয়ে দিতেই নতুন কাউকে পেয়ে গেছি। এই ব্লগটাই এক পরম বন্ধু। এই ব্লগ জগত থেকেও কেউ কেউ হয়ে গেছে অনেক বেশি আপন। অনলাইন জগতেই তৃণা, নাবিলা, দ্রোহ, রানা, পার্থ, পাপীর মতন ভাই-বোন-বন্ধু পেয়েছি। আবার এই সময়েরই মাঝে কেউ ডুব মেরেছে, কোথায় জানি না, আর কেউ তার স্বরূপ চিনিয়েছে নতুন করে, অদ্ভুত সাজে। এরই সাথে বনিতার মতন এক বন্ধু পেয়েছি যাকে আপন ভাবা যায়, যার সাথে প্রাণখুলে কথা বলা যায়।

মাঝে মাঝে বন্ধুদের ওপর অনেক অভিমান হয়। মনে হয় জেমসের মতন করে গেয়ে উঠিঃ

যেদিন বন্ধু চলে যাবো, চলে যাবো বহুদূরে...
ক্ষমা করে দিয়ো আমায়,ক্ষমা করে দিয়ো...
মনে রেখো কেবল একজন ছিলো
যে ভালোবাসতো শুধুই তোমাদের...
চোরা সুরের টানেরে বন্ধু মনে যদি ওঠে গান,
গানে গানে রেখো মনে, ভুলে যেয়ো অভিমান...
মনে রেখো কেবল একজন ছিলো
যে ভালোবাসতো শুধুই তোমাদের...
ভরা নদীর বাঁকেরে বন্ধু ঢেউয়ে ঢেউয়ে দোলে প্রাণ,
চলে যেতে হবে ভেবে কেঁদে ওঠে মন প্রাণ...


মনে গেঁথে থাকা নামগুলোর ভেতর অনেকেরই নাম নিলাম শুধু একজনের নাম নিলাম না। নিবো না। ও এগিয়ে চলুক তার নতুন জীবনে, জীবনটাকে রাঙাক নতুন করে নতুন মানুষের সাথে। ও যা করার করেছে, যা হবার হয়েছে। ওর দোষগুলো মাফ করে দিলাম, আর ও যেন আমার দোষগুলোকে মাফ করে দেয়। আর বলবো, ও যেন ভালো থাকে।

অনেক কথাই বলে ফেললাম। শেষটা করছি একটা কবিতা দিয়ে। কবিতাটার আগে দূরে-কাছের সব বন্ধুদের জানাই উষ্ণ শুভেচ্ছা। কারো মনে কোন কষ্ট দিয়ে থাকলে মাফ করে দিয়ো। হয়তো কষ্ট দিয়েছি, তবে মনে রেখো এই আমি শুধু ভালোবাসতেই চেয়েছিলাম, হয়তো পারি নি।


বন্ধুত্ব

মনের সাথে মনেরই মিল, প্রাণের সাথে প্রাণ।
বুকের মাঝে আয়রে সখা, আয় ধরি সে গান।
ছোট্টবেলা নদীর ধারে, জলের মাঝে পা দুলিয়ে
গান জুড়োতাম গলা ছেড়ে।সময়টা দেয় সব ভুলিয়ে।
ভুলিনি যে সেসব কথা, কত কথা তোমার-আমার।
বুঝিনি তো দোস্তিটা কী! গুরুত্ব কী ছিলো তোমার!
ঝড়ের রাতে আম কুঁড়োতাম মজিদ মিয়ার বাগে,
ফিরলে বাড়ি কান মলুনি দিতেন যে মা রাগে।
সন্ধ্যা বেলা জ্বরের ঘোরে কেঁপে কেঁপে মরি,
চুরি করে এনে দিতে জ্বর তাড়ানোর বড়ি।
পড়লে ধরা, জ্যাঠামশায় দিলেন তোমায় কত্তো মার।
মার খেয়েছো, দুষ্টুমিটা মানে নি তো একটুও হার।
আজকে যখন একলা থাকি মনটা তো খুব কাঁদে
তোমার থেকে অনেক দূরে জীবনেরই ফাঁদে।
ভাবি নানান কাজের মাঝে লিখবো চিঠি তোমায়ঃ
বন্ধু, তুমি কেমন আছো?? মনে আছে আমায়??
আজকে বুঝি দোস্তিটা কী, আর তুমি কী ছিলে।
যতই থাকো দূরে তুমি, আছো আমার দিলে।

আগস্ট, ২০১০
দেবাশিস্‌ মুখার্জি

রবিবার, ৫ আগস্ট, ২০১২

এই শহর

 


এই শহর

রিকশায় করে চলছি এ আমি,
মতিঝিল যাবো।
আটকে গেলাম ভীড়ের মাঝে শান্তিনগর মোড়ে।
সব দিক থেকে সব দিক ছোটে রিকশা মিছিল!
ঘড়ির সময় সামনে এগোয়,
রিকশা আগায় নাতো!
ভাঙাচূরা বাস আঁকা-বাঁকা করে যানজটেরই মাঝে,
মাইজভাণ্ডারী বাজে।

আমি চারদিক দেখিঃ
তরুণীরা যায়, কলেজী পোষাক পরে।
সিদ্ধেশ্বরী??
ভিকারুন্নেসা??
কিংবা অন্য কিছু??
কারো ছোট চুল,
কারো বেণী করা,
কেউ বা দিয়েছে ছেড়ে।
আর বাতাসেতে মৃদু দোল খায় রেশম কালো চুল,
সাথে থাকে জোড়া দুল!

খোলা ডাস্টবিন,
পুতময় বায়ু,
মাছি ভনভন।

আমার অন্য দিকে মন,
আমার চোখে ভাসে কত পুরোনো স্মৃতি!
পুরোনো ভাবনা এসে সুখ-দুখ দেয় আমায়,
আমি দুলি ভাবনায়।

হঠাৎ ভাবনা ভাঙে হাইড্রোলিকের হর্ণে!
আদ্বীনের ছোট গাড়ি,
আমার কান করে খানখান ওর বিকট হুইসেলে।
ভেতরেতে রোগী অস্থির,
এই বুঝি গেল গেল!
মুখেতে শ্বাসের মুখোশ।
রইবে কি ওর হুঁশ??

একটা তরুণ ছেলে গাল দিয়ে যায় জোরে,
আজ চাকরিটা বুঝি গেল!
কাকে দেয় ও গাল??
নিজের ফাঁটা কপাল??
এই শহরের মেয়র??
নাকি ঐ ট্রাফিক পুলিশ??

ডানে-বায়ে লোকে হাঁচি-কাশি দেয় কালচে ধোঁয়ার কবলে,
সর্দি ঝাড়ে,
থু-থু ফেলে চলে একটু-একটু পরে।
কিংবা নাকটা খুঁটে,
কিংবা চুলটা নাড়ে,
কিংবা চশমা মোছে,
সবাই ব্যস্ত আছে নিজের মতন করে।

এই এই সব ঘটে চলে রোজ আমার প্রাণের শহরে,
তবু ভালোবাসি ঢাকা,
যাবো না তোমায় ছেড়ে।
রও আমার হৃদয় জুড়ে

বৃহস্পতিবার, ২ আগস্ট, ২০১২

কৃষ্ণকলি

**


কৃষ্ণকলি

আমার
হয় নি দেখা বনলতা সেন,
হয় নি দেখা ছোট্টবেলার প্রেম
রিপন স্ট্রিটের কালো মেম
ম্যারি এন।

আমার
হয় নি দেখা সবিতা-সুরঞ্জনা,
কিংবা লীলা,
কিংবা শ্রীলা,
কিংবা বেলা,
কিংবা মালা,
কিংবা সেই কৈশর-প্রেম
রোমিও হবার রঞ্জনা।

আমি দেখেছি তারে,
যে বেঁছেছে আমারে
আমায় আপন করে
তার ভালোবাসা জোরে,
সে যে আমার প্রাণের মানিক,
আমার কৃষ্ণকলি।

ইলশে গুঁড়ি বৃষ্টির মাঝে,
গুরুম গুরুম করছিলো বাজে,
দেখেছিলাম তাকে
ঝাঁপসা, মোটা কাঁচের ফাঁকে।
আর মজেছিলাম তার হরিণী চোখে।
দেখ্‌ছিলো কি পথের লোকে??
ঘন বরষায়
মজেছিল মন প্রেমের খেলায়,
হাতে হাত র'তো বেলা-অবেলায়...
গভীর রাতে,
তারাদের সাথে,
কিংবা চাঁদের সনে
হারিয়ে যেতাম ঐ দু'জনে,
আমি আর আমার ভালোবাসা,
আমার কৃষ্ণকলি।

হয়তো ছিল একটু কালো,
তবু লাগতো তারে অনেক ভালো।
কোন কোন অলস দুপুর,
সুর তুলতো পায়ের নুপূর...
মুগ্ধ আমি তাকিয়ে র'তাম তারই চোখের 'পরে,
পাতা দু'টো একটুও না নড়ে!
বুঝে নিতাম প্রেমের গভীরতা,
আর হরিণী চোখের মাদকতা,
যে নেশায় ডুবেছিল মন।
দুলেছিলাম আমরা দু'জন --
আমি আর আমার প্রিয়া,
আমার কৃষ্ণকলি।

ভালোবাসা ছায়া
ছোঁয়া-ছুঁয়ি-মায়া,
একটু আদর, কিংবা চুমু ঠোঁটে।
সুখ জুটেছিল তিন মাস মোটে!
ফুরোয় বেলা,
ফুরোয় খেলা।
কাকডাকা এক ভোরে
চলে গেলো সরে
দূরে, বহুদূরে,
কোন এক অচিনপুরে,
আমার জীয়ন কাঠি,
আমার কৃষ্ণকলি।


দেবাশিস্‌ মুখার্জি
১ আগস্ট, ২০১২


**গায়িকা কৃষ্ণকলির ছবিটা প্রতীকি, এর সাথে আমার কৃষ্ণকলির কোন সম্পর্ক নেই।

বুধবার, ১ আগস্ট, ২০১২

একটি খোলা চিঠি



একটি খোলা চিঠি

স্বাধীনতা,
আমি তোরই জন্য প্রহর গুণেছি
রক্তে ভেজা রাজপথে।
স্বাধীনতা,
আমি তোরই জন্য নতুন সেজেছি
লাশে ভরা মৃত্যুরথে।
স্বাধীনতা,
আমি তোরই জন্য নতুন জেগেছি
রেস্কোর্সের ময়দানে।
স্বাধীনতা,
আমি তোরই জন্য ঘরটা ছেড়েছি
জীবনকে নিয়ে খেলে,
আমি তোরই জন্য গ্রেনেড তুলেছি
হাতের কলম ফেলে,
আমি তোরই জন্য সমর লড়েছি
হারিয়েছি এক পা!
চল্লিশ বছর হারিয়ে গেলো
ঘুঁচলো না সেই ঘাঁ...

স্বাধীনতা,
আজ তোরই নামে তাণ্ডব চলে,
শয়তানের কাল্‌ নাচন,
এতটা বছর ভেসে গেলেও
হয়নি কালিমা মোচন।

স্বাধীনতা,
আমিতো চাই নি তোকে
এতটা পঙ্গু করে।
আমিতো চাই নি তোকে
স্বৈরাচারের 'পরে।
আমিতো চাই নি তোকে
আল-বদরের কোলে।
আমিতো চাই নি তোকে
সন্ত্রাসের আদলে।
আমিতো চাই নি তোকে
রক্তচোষার গোলায়।
আমিতো চাই নি তোকে
দুর্নীতিরই ঝোলায়।

প্রিয় স্বাধীনতা,
অনেক-অনেক রক্ত গেলো,
তুই আসবি কি না বল??
আনতে তোকে জাগবে ছেলে,
খুলবে মেয়ে পায়ের মল,
হাতে হাত রেখে এগিয়ে যাবে।
খুলবে শ্রমিক কল,
এই ভৃত্যেরই পা করবে নৃত্য
ঐ রক্তচোষার বুকে।
আল-বদরে সব হারিয়ে
মরবে ধুঁকে ধুঁকে।
আর ধূর্তরা সব
মর্ত্য ছেড়ে গর্ত নেবে,
দেখবে না ভয়ে আলো।
স্বাধীনতা,
তুমি গরিবের হয়ে
রাজপথে নামো,
সাম্য-আগুণ জ্বালো।

স্বাধীনতা,
তুই দিস না রে আর ফাঁকি...
তোরই আশে কাঁদছে চাষা,
জ্বলছে তাদের আঁখি।
তুই তাণ্ডব হয়ে কাঁপিয়ে দে রে
ধনীর হাতের সাঁকি...
স্বাধীনতা,
তুই দিস নারে আর ফাঁকি...
তুই দিস নারে আর ফাঁকি...



দেবাশিস্‌ মুখার্জি
৩১ জুলাই, ২০১২