মঙ্গলবার, ৭ আগস্ট, ২০১২

রবীন্দ্রনাথের মহাপ্রয়াণ




প্রিয়ারে বেসেছি ভালো ,
বেসেছি ফুলের মঞ্জরিকে ;
করেছে সে অন্তরতম
পরশ করেছে যারে। [১]

এই পোস্টটা সেই প্রিয়াকে উৎসর্গ করলাম যে আমাকে ভালোবাসুক কিংবা না বাসুক আমার ভালোবাসার রবীন্দ্রনাথকে ভালোবাসে, সেই প্রিয়াকে উৎসর্গ করলাম যার প্রেমে পড়তে গিয়ে রবীন্দ্রনাথের প্রেমে মজেছিলাম নতুন করে।


মরণসাগরপারে তোমরা অমর,
তোমাদের স্মরি।
নিখিলে রচিয়া গেলে আপনারই ঘর
তোমাদের স্মরি।
সংসারে জ্বেলে গেলে যে নব আলোক
জয় হোক, জয় হোক, তারি জয় হোক—
তোমাদের স্মরি।
বন্দীদের দিয়ে গেছ মুক্তির সুধা,
তোমাদের স্মরি।
সত্যের বরমালে সাজালে বসুধা,
তোমাদের স্মরি।
রেখে গেলে বাণী সে যে অভয় অশোক,
জয় হোক, জয় হোক, তারি জয় হোক—
তোমাদের স্মরি। [২]

আমার কাছে এই কবিতার মানে 'তোমরা'-তে বিস্তৃত না, এর বিস্তৃতি শুধুই 'তুমি'-তে, আর সেই 'তুমি' হলেন আমার    প্রাণের ঠাকুর, আমার প্রিয় বুড়ো কবি, আমার ভাবনার অবিচ্ছেদ্য অংশ, আমার রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। আজ রবি ঠাকুরের মহাপ্রয়াণ দিবস। আজকে যে সময়ে আমি এই লেখাটা লিখে যাচ্ছি তখন আকাশ কাঁদছে শ্রাবণের ধারায়। আকাশ কেন কাঁদছে তা আকাশই জানে। হয়তো ঠাকুরের স্মরণে, হয়তো রক্তাক্ত আগস্টের শোকে, হয়তো বা এ শুধুই এক সাধারণ শ্রাবণধারা।

কবি বিহারীলাল চক্রবর্তীর একনিষ্ঠ ভক্ত রবি নিজ কাব্যের ব্যাপারে ছিলেন কিঞ্চিৎ সন্দিহান। ভেবেছিলেন লোকে কি এসব পড়বে কিংবা পড়েইবা ভাববে কীসব। তাই আর নিজের নামে লেখেন নি, যাত্রা শুরু করে ভানুসিং ঠাকুর নামে। কিন্তু সময়ের সাথে সেই নিজের ওপর বিশ্বাস না পাওয়া ছোঁকড়াই পরবর্তীতে হয়েছেন কাব্যমহীরূহ। যাঁর ছায়ার নীচে আমরা পাই শান্তির পরশ, প্রেমের দোলা, স্বাধিকার আহ্ববান, মুক্তির ডাক, ঈশ্বরের স্বরূপ। ছোঁকড়া থেকে আমার বুড়ো কবি হয়ে ওঠা এই লোকটা শুধু আমারই মন কাড়েন নি, কেড়েছেন সকল বাঙালির, বিশ্ববাসীর।




আমরা বাঙালিরা রোজ ভাত খেয়ে থাকি। কিন্তু ক'জনে খবর নিয়েছি কে সেই সোনার ফসলের জোগানদাতা! আমরা নেই না সেই খবর। একই রকম ভাবে কোন একটা ভালো কাজের ফলটা আমরা বয়ে চলি, কাজটা জায়গা করে নেয় মহাকালের উঠোনে। কিন্তু কাজের কাজীকে ক'জনেই বা চিনতে চায় কিংবা চিনেও মনে রাখে। একইভাবে রবীন্দ্র ঠাকুর নিজেই সংশয় প্রকাশ করে গিয়েছেন যে, লোকে তাঁর কাব্যফসল ঠিকই ঘরে তুলে নেবে, কিন্তু তাঁর তো আর লোকের ঘরে থাকা হবে না।


আমি শীত গ্রীষ্ম বর্ষা মানি নি, কতবার সমস্ত বৎসর ধরে পদ্মার আতিথ্য নিয়েছি, বৈশাখের খররৌদ্রতাপে, শ্রাবণের মুষলধারাবর্ষণে। পরপারে ছিল ছায়াঘন পল্লীর শ্যামশ্রী, এ পারে ছিল বালুচরের পাণ্ডুবর্ণ জনহীনতা, মাঝখানে পদ্মার চলমান স্রোতের পটে বুলিয়ে চলেছে দ্যুলোকের শিল্পী প্রহরে প্রহরে নানাবর্ণের আলোছায়ার তুলি। এইখানে নির্জন-সজনের নিত্যসংগম চলেছিল আমার জীবনে। অহরহ সুখদুঃখের বাণী নিয়ে মানুষের জীবনধারার বিচিত্র কলবর এসে পৌঁচচ্ছিল আমার হৃদয়ে। মানুষের পরিচয় খুব কাছে এসে আমার মনকে জাগিয়ে রেখেছিল। তাদের জন্য চিন্তা করেছি, কাজ করেছি, কর্তব্যের নানা সংকল্প বেঁধে তুলেছি, সেই সংকল্পের সূত্র আজও বিচ্ছিন্ন হয় নি আমার চিন্তায়। সেই মানুষের সংস্পর্শেই সাহিত্যের পথ এবং কর্মের পথ পাশাপাশি প্রসারিত হতে আরম্ভ হল আমার জীবনে। আমার বুদ্ধি এবং কল্পনা এবং ইচ্ছাকে উন্মুখ করে তুলেছিল এই সময়কার প্রবর্তনা— বিশ্বপ্রকৃতি এবং মানবলোকের মধ্যে নিত্যসচল অভিজ্ঞতার প্রবর্তনা। এই সময়কার প্রথম কাব্যের ফসল ভরা হয়েছিল সোনার তরীতে। তখনই সংশয় প্রকাশ করেছি, এ তরী নিঃশেষে আমার ফসল তুলে নেবে কিন্তু আমাকে নেবে কি। [৩]


ঠাঁই নাই, ঠাঁই নাই— ছোটো সে তরী
আমারি সোনার ধানে গিয়েছে ভরি।
শ্রাবণগগন ঘিরে
ঘন মেঘ ঘুরে ফিরে,
শূন্য নদীর তীরে
রহিনু পড়ি—
যাহা ছিল নিয়ে গেল সোনার তরী। [৪]

মহাকাল রূপ সোনার তরী ঠাকুরের সব সোনার ফসল তুলে রেখেছে, যা আমরা আজও ভোগ করে চলেছি। ঠাকুরের কাব্যসুধা আমাদের আন্দোলিত করে প্রতিনিয়ত। কবির ফসল চির অমর, চির সবুজ, সকল কালের, সকল বয়সের। কিন্তু ব্যক্তি কবি অমর হতে পারেন নি। তাঁকে দেহ ত্যাগ করতে হয়েছে সময়েরই সাথে। তাঁর নশ্বর দেহ অমর হতে পারে নি, কিন্তু ঠাকুর আর তাঁর সৃষ্টি কর্ম অমর হয়ে আছে বাঙালির বুকে, বিশ্ববাসীর মনে।

শেষ বয়সে এসে কবি তাঁর পরপারের ডাক স্পষ্টভাবে শুনতে পাচ্ছিলেন আর সে কথা তিনি তার কাব্যে প্রকাশ করে গিয়েছিলেন। এর একটা নমুনা খুঁজে পাওয়া যায় কবির আশি বছর পুর্ণ হবার ক্ষণে লিখে যাওয়া এক অমর কবিতাতে। কবিতাটিতে তাঁর নিজ জীবন নিয়ে চিন্তাধারাটা স্পষ্টরূপে ধরা দেয়ঃ


জীবনের আশি বর্ষে প্রবেশিনু যবে
এ বিস্ময় মনে আজ জাগে—
লক্ষকোটি নক্ষত্রের
অগ্নিনির্ঝরের যেথা নিঃশব্দ জ্যোতির বন্যাধারা
ছুটেছে অচিন্ত্য বেগে নিরুদ্দেশ শূন্যতা প্লাবিয়া
দিকে দিকে,
তমোঘন অন্তহীন সেই আকাশের বক্ষস্তলে
অকস্মাৎ করেছি উত্থান
অসীম সৃষ্টির যজ্ঞে মুহূর্তের স্ফুলিঙ্গের মতো
ধারাবাহী শতাব্দীর ইতিহাসে।
এসেছি সে পৃথিবীতে যেথা কল্প কল্প ধরি
প্রাণপঙ্ক সমুদ্রের গর্ভ হতে উঠি
জড়ের বিরাট অঙ্কতলে
উদ্‌ঘাটিল আপনার নিগূঢ় আশ্চর্য পরিচয়
শাখায়িত রূপে রূপান্তরে।
অসম্পূর্ণ অস্তিত্বের মোহাবিষ্ট প্রদোষের ছায়া
আচ্ছন্ন করিয়া ছিল পশুলোক দীর্ঘ যুগ ধরি;
কাহার একাগ্র প্রতীক্ষায়
অসংখ্য দিবসরাত্রি-অবসানে
মন্থরগমনে এল
মানুষ প্রাণের রঙ্গভূমে;
নূতন নূতন দীপ একে একে উঠিতেছে জ্বলে,
নূতন নূতন অর্থ লভিতেছে বাণী;
অপূর্ব আলোকে
মানুষ দেখিছে তার অপরূপ ভবিষ্যের রূপ,
পৃথিবীর নাট্যমঞ্চে
অঙ্কে অঙ্কে চৈতন্যের ধীরে ধীরে প্রকাশের পালা —
আমি সে নাট্যের পাত্রদলে
পরিয়াছি সাজ।
আমারো আহ্বান ছিল যবনিকা সরাবার কাজে,
এ আমার পরম বিস্ময়।
সাবিত্রী পৃথিবী এই, আত্মার এ মর্তনিকেতন,
আপনার চতুর্দিকে আকাশে আলোকে সমীরণে
ভূমিতলে সমুদ্রে পর্বতে
কী গূঢ় সংকল্প বহি করিতেছে সূর্যপ্রদক্ষিণ —
সে রহস্যসূত্রে গাঁথা এসেছিনু আশি বর্ষ আগে,
চলে যাব কয় বর্ষ পরে। [৫]

জীবনের সায়াহ্নে পৌঁছে চলে যাওয়ার ডাক পাওয়ার কথা তাঁর 'জন্মদিনে' কাব্যগ্রন্থের অন্যান্য জায়গাতেও প্রকাশ পেয়েছে। যেখানে কবি অত্যন্ত বিনয়ের সাথেই প্রকাশ করেছেন, যে মাটি হতে তাঁর শুরু সেমাটিতেই তাঁকে ফেরত যেতে হবে। মানবদেহ ত্যাগ করে কালের মৃত্যু অন্ধকারে তাঁকে হারিয়ে যেতে হবে।


ফসল গিয়েছে পেকে,
দিনান্ত আপন চিহ্ন দিল তারে পাণ্ডূর আভায়।
আলোকের ঊর্ধ্বসভা হতে
আসন পড়িছে নুয়ে ভূতলের পানে।
যে মাটির উদ্‌বোধন বাণী
জাগায়েছে তারে একদিন,
শোনো আজি তাহারই আহ্বান
আসন্ন রাত্রির অন্ধকারে।
সে মাটির কোল হতে যে দান নিয়েছে এতকাল
তার চেয়ে বেশি প্রাণ কোথাও কি হবে ফিরে দেওয়া
কোনো নব জন্মদিনে নব সূর্যোদয়ে! [৬]

যাবার সময়ে নিজেই বলে গেছেন তাঁর সময় হয়েছে কিন্তু তিনি জ্বলে রইবেন ধ্রুবতারাসম। সত্যিই আমার বুড়ো কবিটা এখনো জ্বলজ্বল করছে ধ্রুবতারাসম। তাঁর আলোর কোন ক্ষয় নেই। এ অক্ষয়, এ অবিনশ্বর।


সমুখে শান্তিপারাবার ,
ভাসাও তরণী হে কর্ণধার।
তুমি হবে চিরসাথি ,
লও লও হে ক্রোড় পাতি ,
অসীমের পথে জ্বলিবে জ্যোতি
ধ্রুবতারকার।

মুক্তিদাতা , তোমার ক্ষমা , তোমার দয়া
হবে চিরপাথেয় চিরযাত্রার।

হয় যেন মর্ত্যের বন্ধন ক্ষয় ,
বিরাট বিশ্ব বাহু মেলি লয় ,
পায় অন্তরে নির্ভয় পরিচয়
মহা-অজানার। [৭]

ইশ, যদি আমার জন্মটা হতো আগে, যদি দেখতে পেতাম তাঁকে। জীবনের বড় একটা আক্ষেপ কেন আমি কবিকে দেখতে পারি নি, তাঁর পা ছুঁয়ে শ্রদ্ধা জানাতে পারি নি -  এ সাধ আর মিটবার নয়। আমরা আর কখনই কবিকে খুঁজে পাবো না, যতই শোকময় হয়ে, সকরুণভাবে কাঁদি না কেন। আমরা রয়ে আছি মনিবহারা কুকুরের মতন। আমরা শুধু মনিবের ফেলে চৌকিসম সাহিত্যসুধা পান করে মনের পিয়াস মেটাতে পারি।


কুকুর মনিবহারা যেমন করুণ চোখে চায়
অবুঝ মনের ব্যথা করে হায় হায় ;
কী হল যে , কেন হল , কিছু নাহি বোঝে —
দিনরাত ব্যর্থ চোখে চারি দিকে খোঁজে।
চৌকির ভাষা যেন আরো বেশি করুণ কাতর ,
শূন্যতার মূক ব্যথা ব্যাপ্ত করে প্রিয়হীন ঘর। [৮]

৬ আগস্ট, ২০১২
দেবাশিস্‌ মুখার্জি

তথ্যসূত্রাবলিঃ

[১] শেষ লেখা - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। প্রকাশকালঃ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মৃত্যুর পর, ১৯৪১ খ্রীষ্টাব্দ।
[২] মরণসাগরপারে তোমরা,গীতবিতান - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। প্রকাশ কালঃ জ্যৈষ্ঠ, ১৩৩৩ বঙ্গাব্দ।
[৩] ভূমিকা, সোনার তরী - রবীন্দ্রনাথঠাকুর। ভুমিকা সংযোজন কালঃ বৈশাখ, ১৩৪৭ বঙ্গাব্দ।
[৪] সোনার তরী, সোনার তরী - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। প্রকাশ কালঃ ১৩০০ বঙ্গাব্দ।
[৫] জীবনের আশি বর্ষে প্রবেশিনু যবে, জন্মদিনে - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। প্রকাশ কালঃ ১৩৪৭ বঙ্গাব্দ।
[৬] ফসল গিয়েছে পেকে, জন্মদিনে - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। প্রকাশ কালঃ ১৩৪৭ বঙ্গাব্দ।
[৭], [৮] শেষ লেখা - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। প্রকাশকালঃ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মৃত্যুর পর, ১৯৪১ খ্রীষ্টাব্দ।

চিত্রউৎসাবলিঃ ভারতীয় পুরোনো ছবির সাইট।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন