বৃহস্পতিবার, ২৮ জুন, ২০১২

দুষ্টু দোয়েল

দুষ্টু দোয়েল

আজ ভোমরা বেড়ায় ঘুরে পথটা ভুলে
পাগল করা বকুলেরই ফুলে-ফুলে,
ঘুরছে উড়ে প্রজাপতি দুলে-দুলে।
ভোর স্বপনের ভালোবাসা আমায় ছুঁলে
আজকে আমি উঠবো জেগে নতুন করে।
দখিন কোণের পবন ছাওয়া নতুন ভোরে
পাগলা দোয়েল শিস্‌ দিয়ে যায় আমার দোরে।
এই আমি যে খুঁজে ফিরি আমার তোরে।

তুই দেখা কি দিবি নারে এই ক্ষ্যাপাকে?
এই ক্ষ্যাপা যে ক্ষেপে গিয়ে তোকেই ডাকে।
তুই কি ভালোবাসবি নারে এই আমাকে?
ওরে প্রিয়া, আসবি নারে কাজের ফাঁকে?
সব দোয়েলের মধু-মাখা শিসেরই মাঝ
আমার দুষ্টু দোয়েলটারে খুঁজছি যে আজ।
ওরে পাখি, ছুড়ে ফেলে সবখানি লাজ
এই আমাকে ভালোবেসে রাঙা এ সাঁঝ।

দেবাশিস্‌ মুখার্জি
১লা আষাঢ়, ১৪১৯  

বুধবার, ২৭ জুন, ২০১২

প্রেমের জ্বালা

শুধু স্পেস থাকে না। তাই স্পেসের পরিবর্তে '_' দিলাম। এটাকে ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখার অনুরোধ রইলো। আশাকরি কবিতাটা খারাপ লাগবে না। :)

আজ__________ঝর-ঝর করে___বাদর ঝরে
__________________________টিনের পরে;
_____________আমি শুনে যাই,___মনে লাগে ঘোর।
_____________আনমনে গাই___শুধুই ট্যাগোর।
_____________জানা ছিল সব___ঐ বুড়োটার।

আর___________এ বাদল বেলা___করছে খেলা
___________________________তীব্র জ্বালা।
______________কষ্টমালায়    কাঁদছে এমন,
______________তীব্র জ্বালায়     মনটা এখন
______________চাইছে রেহাই প্রেম খেলাটার।


সেই___________প্রেম খেলাটায়___কী জ্বালা হায়
__________________________সারা বেলায়।
______________তাই বলি বঁধু___মজিস না কেউ।
দেয় ভুলিয়ে______বাকি সব মধু___প্রেমটার ঢেউ,
______________মনের আগুন____শুধু জ্বলে রয়।


তবু___________পরে রই আমি -__নয়তো দামি
___________________________এই আসামি
______________মনেরই দামে।___তবু জ্বলে রয়
ভালোবাসাটা_____মনেরই খামে।___তাই সুখ হয়!
______________এই অসুখের___নাই কোন ক্ষয়!

বৃহস্পতিবার, ২১ জুন, ২০১২

রুদ্র...


রুদ্র। প্রিয় মানুষ, প্রিয় কবি। পুরো নাম রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ। অনেকেই হয়তো তাকে চেনেন না কিংবা একটি বারের জন্যেও তার ছবিটি দেখেন নি কিন্তু রেডিও, টেলিভিশন, ইউটিউব কিংবা আড্ডায় ছেলে-ছোকরাদের গিটারে ঠিকই শুনেছেনঃ

আমার ভেতর বাহিরে অন্তরে অন্তরে
আছো তুমি হৃদয় জুড়ে...
...... ...... ...... ...... ......
...... ...... ...... ...... ......
ভালো আছি ভালো থেকো
আকাশের ঠিকানায় চিঠি লিখো...

২৯ আশ্বিন, ১৩৬৩ বঙ্গাব্দে (১৬ অক্টোবর, ১৯৫৬) প্রিয় এই কবির জন্ম হয়। বাবার নাম শেখ ওয়ালীউল্লাহ আর মায়ের নাম শিরিয়া বেগম। পৈতৃক নিবাস র্বাতমান বাগেরহাট জেলার মংলার সাহেবের মেঠ গ্রামে হলেও তার জন্মহয় বরিশাল জেলার আমানতগঞ্জের রেডক্রস হাসপাতালে। 

শৈশবের অধিকাংশটাই কেটেছে নানাবাড়িতে যা বাগেরহাটের মংলা থানার মিঠেখালি গ্রামে অবস্থিত। নানাবাড়ির গ্রামের পাঠশালাতেই তার হাতেখড়ি ঘটে। পৌনে আট বছর বয়সে দ্বিতীয় শ্রেণিতে ভর্তি হন ঐ গ্রামেই নানার নামে প্রতিষ্ঠিত 'ইসমাঈল মেমোরিয়ার স্কুল' এ। তবে এই স্কুলেও বেশিদিন আর পড়া হয় নি। ১৯৬৬ সালে মংলাতেই 'সেন্ট পলস উচ্চ বিদ্যালয়' এর চতুর্থ শ্রেণিতে ভর্তি হন। এই বয়সেই রুদ্রের বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা পড়া ও কবিতা আবৃত্তির প্রতি পবল ঝোঁক প্রকাশ পায়।

সেই শৈশবেই একটা লাইব্রেরির দরকার হয়ে পড়লো রুদ্রের। চারপাশে যখন লাইব্রেরি নেই তখন নিজেই একটা খুলবেন বলে ঠিক করলেন। কিন্তু টাকা আসবে কোত্থেকে?! মামাতো ভাইদের দলে ভেড়ালেন। একসাথে নানীর ট্রাঙ্ক থেকে টাকা চুরি করলেন। সেই টাকা দিয়ে গড়ে তোলা হল একটা লাইব্রেরি, নাম দেওয়া হল - বনফুল। 

খেলাধূলায় বেজায় আগ্রহ ছিল। মংলায় প্রথম ক্রিকেট দল তৈরি করেন কিশোর বন্ধুদের নিয়ে। তবে খেলাধূলার চাইতেও অধিক আগ্রহ ছিল লেখা-লেখির প্রতি। তাই ঐ বয়সেই তার কাঁচা হাতে লেখা-লেখি শুরু হয়ে যায়।

১৯৬৯ এ রুদ্রের বয়স মাত্র বারো কি তের। চারদিক উত্তাল গণঅভ্যূত্থানে। ঐ কিশোর বয়সেই তার আর বাড়ি বসে থাকা হল না। যোগ দিলে গণজোয়ারে। ঐ বয়সেই হরতাল-মিছিল-মিটিং এ নিয়মিত যোগ দিতে থাকেন।

এল ১৯৭১ সাল। নবম শ্রেণির ছাত্র মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ কিন্তু তার বাবাকে পাকসেনারা উঠিয়ে নিয়ে গেল। মা আর তাকে হারাতে চান নি বলেই যুদ্ধে যেতে দেন নি। কিন্তু যুদ্ধে না যেতে পারার কষ্ট আর চারপাশের হত্যাযজ্ঞ, রক্তের নদী তাকে তীব্রভাবে আন্দোলিত করে, যা আমরা পরবর্তীতে তার বিভিন্ন কবিতায় দেখতে পাই। 

যুদ্ধশেষে ১৯৭২ এ ঢাকা চলে এলেন। উঠলেন লালবাগে সেজ মামার বাসায়। 'ওয়েস্ট এন্ড হাই স্কুল' এ দশম শ্রেণিতে ভর্তি হলেন। বাবার ইচ্ছেতেই মনেমনে ডাক্তার হবার ইচ্ছে জাগে। তাই ঠিক করেন এবার পড়াশোনায় মনযোগ দিবেন। কিন্তু  যার সাহিত্যিক হবার কথা তার কি আর টানা পড়াশোনায় মন বসে! পড়াশোনা থাকলো পড়াশোনার যায়গায় আর তিনি মন দিলেন গল্প, কবিতা, গান আর নাটক লেখায়। ঐ বছরই 'দৈনিক আজাদ' পত্রিকায় প্রকাশিত হয় তার কবিতাঃ 'আমি ঈশ্বর আমি শয়তান'।

১৯৭৩ সালে একুশের সংকলন 'দুর্বিনীত' এর সহযোগী সম্পাদকের কাজ শুরু করেন। 'দুর্বিনীত' এর সম্পাদক ছিলেন মিয়া মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান। সামনে এস,এস,সি, পরীক্ষা থাকায় এত সব কাজের মাঝে পড়াশোনাটাও চলছিল। বাবা-মায়ের দেওয়া নাম শুধুই মুহম্মদ শহিদুল্লাহ হলেও নিজ ইচ্ছেতেই এস,এস,সি, রেজিস্ট্রশনে নিজের নামের সাথ যুক্ত করলেন 'রুদ্র', হলেন রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ। পরীক্ষা ভালোই হল।বিজ্ঞান বিভাগ থেকে চার বিষয়ে লেটার মার্কস সহ প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হলেন। এরপর ঢাকা কলেজে কলা বিভাগে ভর্তি হলেন। এর মাঝেই একদিন বাংলাদেশ বেতারে পাঠ করলেন নিজের লেখা কবিতাঃ 'এখনো বেঁচে আছি'।  

লেখালেখিতেই পুরো ব্যস্ত হয়ে গেলেন। কলেজে যাওয়া প্রায় বন্ধই হয়ে গেল। ১৯৭৪ এ প্রকাশ পেল তার সম্পাদিত কবিতাপত্র 'অনামিকার অন্যচোখ এবং চুয়াত্তোরের প্রসব যনন্ত্রনা', '৭৫ এ প্রকাশ পেল তারই সম্পাদিত কবিতাপত্র 'অশ্লীল জোৎস্নায়' যেখানে তিনি সম্পাদকীয়তে 'উপলিকা' নামে 'না-কবিতা, না-গল্প' আঙ্গিকের প্রস্তাব করেন। পুরো কলেজ জীবনে ১৮ দিন ক্লাশে গিয়েছেন আর এইচ,এস,স, তে ফল পেলেন দ্বিতীয় বিভাগ। ১৯৭৬ এ এসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের স্নাতক (সম্মান) শ্রেণিতে ভর্তি হলেন।

বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে আলী রিয়াজ এর সাথে ভালো বন্ধুত্ব হয়ে যায়। ১৯৭৮ এ বন্ধু আলী রিয়াজ, মঈলুল আহসান সাবের ও রুদ্র মিলে যৌথ সম্পাদনায় প্রকাশ করেন প্রবন্ধ সংকলনঃ 'স্বরূপ অন্বেষা'।আবিদ রহমান, সলিমুল্লাহ খান সহ আরও অনেকের প্রবন্ধ নিয়ে এই বইটি প্রকাশ করে 'তিতলী প্রকাশনী'। এটি যৌথভাবে সম্পাদিত হলেও 'প্রবেশক' শিরনামে সম্পাদকীয়টি লেখেন রুদ্র নিজেই। ডাকসু নির্বাচনে ছাত্র ইউনিয়নের মনোনীত পরিষদে সাহিত্য সম্পাদক পদে প্রার্থী হন কিন্তু বন্ধু আলী রিয়াজের কাছে হেরে যান। একই সময়ে তার কবিবন্ধু কামাল চৌধুরী, জাফর ওয়াজেদ, রাজা সেলিম সহ আরো অনেককে নিয়ে গঠন করেন 'রাখাল' নামের সাহিত্য ও প্রকাশনা সংস্থা।

১৯৭৯ তে প্রকাশ পায় রুদ্রের প্রথম কাব্যগ্রন্থ 'উপদ্রুত উপকূল'। এর প্রকাশক ছিলেন আহমদ ছফা, বুক সোসাইটি, বাংলাবাজার। তরূণ পাঠক ও কাব্যপ্রেমীরা এই কাব্যগ্রন্থটিকে রীতিমত লুফেই নেন। এর প্রথম কবিতাটাই হল 'বাতাসে লাশের গন্ধ' যা বাংলাদেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবিতা। এই কবিটাটি যেকোন বাঙালিকেই নতুন করে নাড়া দিবে -

আজো আমি বাতাসে লাশের গন্ধ পাই,
আজো আমি মাটিতে মৃত্যূর নগ্ননৃত্য দেখি,
ধর্ষিতার কাতর চিৎকার শুনি আজো আমি তন্দ্রার ভেতরে -
এ দেশ কি ভুলে গেছে সেই দু:স্বপ্নের রাত, সেই রক্তাক্ত সময় ?

বাতাসে লাশের গন্ধ ভাসে,
মাটিতে লেগে আছে রক্তের দাগ।
এই রক্তমাখা মটির ললাট ছুঁয়ে একদিন যারা বুক বেঁধেছিলো,
জীর্ন জীবনের পুঁজে তারা খুঁজে নেয় নিষিদ্ধ আধাঁর।
আজ তারা আলোহীন খাঁচা ভালোবেসে জেগে থাকে রাত্রির গুহায়।

এ যেন নষ্ট জন্মের লজ্জায় আরষ্ট কুমারী জননী,
স্বাধীনতা – একি তবে নষ্ট জন্ম ?
                    একি তবে পিতাহীন জননীর লজ্জার ফসল ?

জাতির পতাকা খামচে ধরেছে আজ পুরোনো শকুন।

বাতাশে লাশের গন্ধ-
নিয়ন আলোয় তবু নর্তকীর দেহে দুলে মাংশের তুফান।
মাটিতে রক্তের দাগ -
চালের গুদামে তবু জমা হয় অনাহারী মানুষের হাড়।

এ-চোখে ঘুম আসেনা। সারারাত আমার ঘুম আসেনা-
তন্দ্রার ভেতরে আমি শুনি ধর্ষিতার করুণ চিৎকার,
নদীতে পানার মতো ভেসে থাকা মানুষের পচা লাশ,
মুন্ডহীন বালিকার কুকুরে খাওয়া বিভৎস শরীর
ভেসে ওঠে চোখের ভেতরে। আমি ঘুমুতে পারিনা, আমি
                                                         ঘুমুতে পারিনা…

রক্তের কাফনে মোড়া – কুকুরে খেয়েছে যারে, শকুনে খেয়েছে যারে,
সে আমার ভাই, সে আমার মা, সে আমার প্রিয়তম পিতা।
স্বাধীনতা –  সে-আমার স্বজন, হারিয়ে পাওয়া একমাত্র স্বজন ,
স্বাধীনতা – সে-আমার প্রিয় মানুষের রক্তে কেনা অমূল্য ফসল।

ধর্ষিতা বোনের শাড়ি ওই আমার রক্তাক্ত জাতির পতাকা।।

এ বছরের ফেব্রুয়ারিতে আবিদুর রহমানের সম্পাদনায় প্রকাশ পায়  মুক্তিযুদ্ধের ঘটনা নিয়ে  গল্প সংকলন 'প্রেক্ষাপট-৭১' যার প্রকাশক ছিলেন রুদ্র। এবছরই স্নাতক (সম্মান)শেষ বর্ষের পরীক্ষা দেবার কথা থাকলেও তার দেওয়া হয় নি। উপস্থিতির হার অনেক কম থাকায় বিভাগীয় প্রধান তাকে পরীক্ষায় অংশ নিতে দেন নি।

১৯৮০ সালে 'উপদ্রুত উপকূল' কাব্যগ্রন্থের জন্য 'সংস্কৃতি সংসদ' থেকে 'মুনীর চৌধূরী সাহিত্য পুরস্কার' লাভ করেন। গত বছর না পারলেও এ বছর স্নাতক (সম্মান)শেষ বর্ষের পরীক্ষা দেন এবং দ্বিতীয় শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হন। 

১৯৮১ সালের ২৯ জানুয়ারি বিয়ে করেন তসলিমা নাসরীনকে। এবছরই দ্রাবিড় প্রকাশনী থেকে প্রকাশ পায় দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ 'ফিরে পেতে চাই স্বর্নগ্রাম' এবং এটি যুগ্মভাবে 'মুনীর চৌধূরী সাহিত্য পুরস্কার' লাভ করে। এবছর সফলভাবে স্নাতোকোত্তরের পাঠটা চুকিয়ে ফেলেন।

১৯৮২ সালের স্বৈরাচার এরশাদ বিরোধী ছাত্র আন্দোলন শুরু হতে থাকে। ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি সময়ে ৪২ টি সাংস্কৃতিক সংগঠন মিলে গঠিত হয় 'সংগ্রামী সাংস্কৃতিক জোট' যা পরবর্তীকালে 'সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট' নামে আত্মপ্রকাশ করে। রুদ্র এর প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ও আহ্বায়ক ছিলেন। 

১৯৮৪ তে প্রকাশ পায় রুদ্রের তৃতীয় কাব্যগ্রন্থ 'মানুষের মানচিত্র', প্রকাশ করে সব্যসাচী প্রকাশনী। ১৯৮৬ তে দ্রাবিড় প্রকাশনী পরকাশ করে রুদ্রের চতুর্থ কাব্যগ্রন্থ 'ছোবল' যা ছিল তৎকালীন স্বৈরাচার সরকারের অমানবিক অত্যচারের বীভৎসতা। এই কাব্যগ্রন্থের 'কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প' একটি অসাধারণ কবিতা-

তাঁর চোখ বাঁধা হলো।
বুটের প্রথম লাথি রক্তাক্ত করলো তার মুখ।
থ্যাতলানো ঠোঁটজোড়া লালা-রক্তে একাকার হলো,
জিভ নাড়তেই দুটো ভাঙা দাঁত ঝরে পড়লো কংক্রিটে।
মা…..মাগো….. চেঁচিয়ে উঠলো সে।

পাঁচশো পঞ্চান্ন মার্কা আধ-খাওয়া একটা সিগারেট
প্রথমে স্পর্শ করলো তার বুক।
পোড়া মাংসের উৎকট গন্ধ ছড়িয়ে পড়লো ঘরের বাতাসে।
জ্বলন্ত সিগারেটের স্পর্শ
তার দেহে টসটসে আঙুরের মতো ফোস্কা তুলতে লাগলো।

দ্বিতীয় লাথিতে ধনুকের মতো বাঁকা হয়ে গেলো দেহ,
এবার সে চিৎকার করতে পারলো না।

তাকে চিৎ করা হলো।
পেটের ওপর উঠে এলো দু’জোড়া বুট, কালো ও কর্কশ।
কারণ সে তার পাকস্থলির কষ্টের কথা বলেছিলো,
বলেছিলো অনাহার ও ক্ষুধার কথা।

সে তার দেহের বস্ত্রহীনতার কথা বলেছিলো-
বুঝি সে-কারনে
ফর ফর করে টেনে ছিঁড়ে নেয়া হলো তার শার্ট।
প্যান্ট খোলা হলো। সে এখন বিবস্ত্র, বীভৎস।

তার দুটো হাত-
মুষ্টিবদ্ধ যে-হাত মিছিলে পতাকার মতো উড়েছে সক্রোধে,
যে-হাতে সে পোস্টার সেঁটেছে, বিলিয়েছে লিফলেট,
লোহার হাতুড়ি দিয়ে সেই হাত ভাঙা হলো।
সেই জীবন্ত হাত, জীবন্ত মানুষের হাত।

তার দশটি আঙুল-
যে-আঙুলে ছুঁয়েছে সে মার মুখ, ভায়ের শরীর,
প্রেয়সীর চিবুকের তিল।
যে-আঙুলে ছুঁয়েছে সে সাম্যমন্ত্রে দীক্ষিত সাথির হাত,
স্বপ্নবান হাতিয়ার,
বাটখারা দিয়ে সে-আঙুল পেষা হলো।
সেই জীবন্ত আঙুল, মানুষের জীবন্ত উপমা।

লোহার সাঁড়াশি দিয়ে,
একটি একটি কোরে উপড়ে নেয়া হলো তার নির্দোষ নোখগুলো।
কী চমৎকার লাল রক্তের রঙ।

সে এখন মৃত।
তার শরীর ঘিরে থোকা থোকা কৃষ্ণচূড়ার মতো
ছড়িয়ে রয়েছে রক্ত, তাজা লাল রক্ত।

তার থ্যাতলানো একখানা হাত
পড়ে আছে এদেশের মানচিত্রের ওপর,
আর সে হাত থেকে ঝরে পড়ছে রক্তের দুর্বিনীত লাভা-

১৯৮৭ এর ফেব্রুয়ারিতে শুরু হয় 'প্রথম জাতীয় কবিতা উৎসব' যার শ্লোগান ছিলঃ 'শৃঙ্খল মুক্তির জন্যে কবিতা'। এটি ছিল স্বৈরাচারী এরশাদ সরকারের আয়োজন করা 'এশীয় কবিতা উৎসব' এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ। এ বছরই তসলিমার সাথে রুদ্রের বিবাহ-বিচ্ছেদ ঘটে। নিখিল প্রকাশন তার পঞ্চম কাব্যগ্রন্থ 'গল্প' প্রকাশ করে। পরের বছর মুক্তধারা প্রকাশনী থেকে প্রকাশ পায় তার ষষ্ঠ কাব্যগ্রন্থ 'দিয়েছিলে সকল আকাশ'...

১৯৮৯ সালে আয়োজিত হয় 'তৃতীয় জাতীয় কবিতা উৎসব' কিন্তু কবিতা পরিষদের অনেকের সাথে বিরোধ হওয়ায় রুদ্র এই আয়োজন বর্জণ করেন। তিনি মনে করেন স্বৈরাচার সরকারের মদদে ঐ পরিষদেও স্বৈরাচারী লোকেরা ঢুকে গিয়েছে। তিনি সকল স্বৈরাচারীর বিরুদ্ধে প্রকাশ্য ঘোষণা দিয়ে মঞ্চে কবিতা পাঠ করেন। শহর ছেড়ে মংলা চলে যান। গঠন করেন সংগঠন 'অন্তর বাজাও' এবং এখানেই সৃষ্টি করেন বিখ্যাত গান 'ভালো আছি ভালো থেকো' যা পরে তাকে শ্রেষ্ঠ গীতিকারের জাতীয় পুরুস্কার এনে দেন যদিও তা তার মরণের পরেই হয়।

১৯৯০ সালে প্রকাশ পায় তার সপ্তম কাব্যগ্রন্থ 'মৌলিক মুখোশ', এটি প্রকাশ পায় সংযোগ প্রকাশনী থেকে। ১৯৯১ সালে 'বাংলাদেশ সংগীত পরিষদ' এর প্রকাশনা সচিব নির্বাচিত হন এবং এবছরই বাংলাদেশ টেলিভিশনের গীতিকার হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হন। কিন্তু বেশি দিন আর কাজ করা হয়ে ওঠে না। বয়স ৩৫ না পেরুতেই ১৯৯১ এর ২১ জুন হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে ইহলোক ত্যাগ করেন।

তিনি শুধু বিদ্রোহ-বিপ্লব-প্রতিবাদেরই কবি ছিলেন না, ছিলেন প্রেমেরও কবি যার প্রমাণ মিলে 'ভালো আছি ভালো থেকো' গানটিতে। তার লেখা একটি বিখ্যাত প্রেম-কবিতা 'দূরে আছো দূরে' -

তোমাকে পারিনি ছুঁতে, তোমার তোমাকে-
উষ্ণ দেহ ছেনে ছেনে কুড়িয়েছি সুখ,
পরস্পর খুড়ে খুড়ে নিভৃতি খুঁজেছি।
তোমার তোমাকে আমি ছুঁতে পারি নাই।

যেভাবে ঝিনুক খুলে মুক্ত খোঁজে লোকে
আমাকে খুলেই তুমি পেয়েছো অসুখ,
পেয়েছো কিনারাহীন আগুনের নদী।

শরীরের তীব্রতম গভীর উল্লাসে
তোমার চোখের ভাষা বিস্ময়ে পড়েছি-
তোমার তোমাকে আমি ছুঁতে পারি নাই।
জীবনের ’পরে রাখা বিশ্বাসের হাত
কখন শিথিল হয়ে ঝ’রে গেছে পাতা।
কখন হৃদয় ফেলে হৃদপিন্ড ছুঁয়ে
বোসে আছি উদাসীন আনন্দ মেলায়-

তোমাকে পারিনি ছুঁতে-আমার তোমাকে,
ক্ষাপাটে গ্রীবাজ যেন, নীল পটভূমি
তছ নছ কোরে গেছি শান্ত আকাশের।
অঝোর বৃষ্টিতে আমি ভিজিয়েছি হিয়া-

তোমার তোমাকে আমি ছুঁতে পারি নাই।।

বৃহস্পতিবার, ১৪ জুন, ২০১২

রোহিঙ্গা নিয়ে কিছু কথা...

গত বেশ কিছুদিন ধরেই চারিদিকে রোহিঙ্গা নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। আলোচনা হবার পেছনের কারণটা হল মায়ানমারের সাম্প্রদায়িক দাঙা যা ঘটে চলছে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী ও মুসলমান রোহিঙ্গাদের মাঝে। আমি ঠিক জানি না যে এবার কে এই ঘটনার সূত্রপাত ঘটিয়েছে, তবে গত বেশ কয়েক দশক ধরেই বার্মিজরা এই রোহিঙ্গাদের আর বার্মিজ বলে মেনে নিচ্ছে না। ওদের দাবি এই রোহিঙ্গারা মূলত বাঙালি। ওরা বাঙালি কিনা তাও নিশ্চিত নই তবে ওদের ভাষা ও সংস্কৃতি প্রমাণ করে ওদের সাথে চাঁটগাইয়াদের যোগসূত্রটা বেশ গাঢ়ই বটে।

বার্মিজ জনগণ ও সামরিক জান্তারা রোহিঙ্গাদের  মায়ানমারের লোক তো ভাবেই না মানুষ ভাবে কি না সন্দেহ। রোহিঙ্গারা তাদের শেষ আশ্রয়স্থল হিসেবে বেছে নিয়েছে বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জেলাগুলোকে। এর আগেই বহু রোহিঙ্গা এখানে এসে শরণার্থী হয়ে আছে বছরের পর বছর ধরে। ওরা নানাভাবে আমাদের জন্য সমস্যা হিসেবেও দেখা দিচ্ছে যা আর আজকে নতুন করে বলতে চাই না। নানাবিধ কারণেই বাংলাদেশ সরকার জাতিসংঘের আহ্বান সত্ত্বেও রোহিঙ্গাদের এদেশে ঢুকতে দিচ্ছে না। সত্যি বলতে এখানে বাঙালিদেরই জায়গা হয় না, পারলে পাহাড়িদের জায়গাটাই দখল করে নেয় এরকম একটা অবস্থায় নতুনদের জায়গা করে দেওয়াটা বিলাসিতারই নামান্তর।

তাই আজ আমরা এই ছবিগুলোকে দেখেও না দেখার ভান করবার চেষ্টা করছিঃ




কিন্তু আজ আমরা ভুলে যাচ্ছি ১৯৪৭ এ  মুসলিম বাঙালিদের  ভারত ছেড়ে পূর্ব বাংলা বা পূর্ব পাকিস্তানে আশ্রয় নেবার কথা। ১৯৪৭, ১৯৬৪-৬৫, ১৯৭১ কিংবা ১৯৯০-১৯৯৯২ ও ২০০১ সালে দলে দলে বাংলাদেশের হিন্দুদের ভারতে চলে যাওয়া। আমরা ১৯৭১ সালে ভারতে আশ্রয় নেবার কথা, প্রায় ১ কোটি শরণার্থীর কথা আজ ভুলে যাচ্ছি। নিচের এই ছবিগুলো কি আজ আমাদের অচেনা হয়ে উঠেছে?





তবে সত্যি কথা বলতে এত শরণার্থীদের বছরের বছর পেলে-পুষে রাখা আমাদের পক্ষে সম্ভব না। তাই আমাদেরকে ভাবতে হবে এর সমাধান করা যায় কীভাবে। যেকোন অসহায় মানুষদের পাশে দাঁড়ানো আমাদের নৈতিক দায়িত্ব। একদিন সবাই আমাদের পাশে না দাঁড়ালেও অনেকেই আমাদের পাশে দাঁড়িয়েছিলো - সেকথা আমরা ভুলে যেতে পারি না, ভুলে যাওয়াটা ঠিক না। কিন্তু আমাদের সাথে রোহিঙ্গাদের অবস্থানের একটা মৌলিক তফাৎ আছে সেটাও আমাদের ভাবতে হবে। আর সেই পার্থক্যটা হলঃ ১৯৭১ বাঙালি তার স্বাধীনতার ঘোষণা পেয়েছিল, একত্রিত হয়েছিল। রোহিঙ্গারা কি তা করেছে?? ওরা কি তা আদৌ চায়?? কিংবা আদৌ পারবে?? যদি সেরকমটা হয় তবে ওদের সাহায্য করাটা হবে আমাদের নৈতিক দায়িত্ব। আর ওরা যদি আমাদের সাহায্য নিয়ে ওদের থাকার জায়গাটুকু বার্মিজদের কাছ থেকে ছিনিয়ে এনে আমাদের সাথে যোগ দিতে চায় তবে ওদের গ্রহণ করাটা নিশ্চই ভুল হবে না।

ছবিঃ অন্তর্জাল

মঙ্গলবার, ১২ জুন, ২০১২

বকুল ফুলের মালা


পৌনে চারটে বাজে। মাত্র পৌনে দু'ঘণ্টাতেই দিব্যর ভাত-ঘুমটা ভেঙে গেল। মেজাজটা খিঁচড়ে আছে। কফির জন্য জল গরম দিয়ে ফ্রেশ হতে গেল। ফ্রেশ হয়ে ফিরে কড়া একটা ব্ল্যাক কফি নিয়ে বসলো। কফিতে আর চুমুক দেওয়া হয় না। কফির পোড়া গন্ধে নাকটা একটু ডুবিয়েই বাইরের দিকে চোখ দেয়। আকাশে অনেক মেঘ। বিষণ্ণ আকাশ দেখে দিব্যর মনটাও বিষণ্ণ হয়ে ওঠে। আকাশের দিকে তাকিয়ে আগের কথা মনে পড়ে যায়। বুকটা হু হু করে ওঠে, আর চোখের কোণাটা ভেজা কিনা তা আর আঁধার ঘরে বোঝা যায় না।

সদরপুরের শৈশব। শৈশবের ভালোবাসা। ভালোবাসার বর্ণা। আট কেলাশে পড়া অবস্থায় মাত্রই একটু-আধটু বুঝতে শিখেছে বন্ধুত্ব কী ব্যাপার। তবে কেলাশের মেয়েরা যে কী সব বলে আর নিজেরা নিজেরাই হাসাহাসি করে তা ওরা ছেলেরা অনেকেই বুঝে উঠতে পারে না। তারপরও কেলাশের বর্ণা আর দিয়ার সাথে ওর খুব ভালো বন্ধুত্ব হয়ে গেছে। রোজ বাড়ি ফেরার পথে বেশ খানিকটা পথ একসাথেই হেঁটে আসতে হয়। ফিরতে ফিরতে এক পুরোনো ভাঙা মন্দিরের পুকুর পাড়ে বসে গল্প করে। কোন কোন দিন দিয়া না থাকলে দিব্য আর বর্ণা পুকুরের সিঁড়িতে বসে পা ডুবিয়ে রাখে। অপর পারের বকুল গাছ থেকে ঝরে পড়া ফুলগুলো ভেসে আসে ওদের পায়ের সামনে। মাঝে মাঝেই বর্ণাটা দিব্যর দিকে তাকিয়ে থাকে, কিছু একটা বোঝাতে চায় কিন্তু দিব্য কিছুই বুঝে উঠতে পারে না।

এভাবেই কেটে যাচ্ছিলো সুখের দিনগুলো। আর দিনকে দিন বর্ণা একটু বেপরোয়া হয়ে উঠছিল দিব্যকে কিছু একটা বোঝানোর জন্য কিন্তু বুদ্ধু দিব্য কি আর তা বোঝে! দেখতে দেখতে গরমে নাভিশ্বাস ওঠার দিন চলে এলো। অবশ্য আগামীকাল থেকেই গ্রীষ্মের ছুটি। তাই ওদের সাথে বেশ কিছুদিন দেখা হবে না বলে দিব্যর মনটা খারাপ ছিলো। আজ আবার দিয়া আসে নি। দিব্য আর বর্ণা চুপচাপ ফিরছে। দু'জনেই কথা বলতে গিয়েও কিছু বলছে না। দিব্য বলতে চাইছিলো যে এই ছুটির দিনে মামার বাড়ি যাবে সে কথা আর বর্ণা দিব্যকে বলতে চাইছিলো মনের গভীর এক অনুভূতির কথা। দু'জনেই ভাঙা মন্দিরটার পুকুর পাড়ের সিঁড়িতে গিয়ে বসলো। বর্ণা কিছু একটা বলতে চাইলো অনেকবার কিন্তু পারলো না। না বলতে পেরে ও দিব্যকে বললো, 'তুই একটু চোখ বোজ তো!' কিন্তু কেন?', দিব্য জিজ্ঞাস করলো। কিন্তু বর্ণা এর উত্তর না দিয়ে আবারো বললো, 'যা বললাম তা একটু করই না!' দিব্য চোখ বোজার কিছুক্ষণ বাদে ওর গালে বর্ণার নরম ঠোঁটের আলতো ছোঁয়া টের পেল। কিছু না বুঝতেই ও একটু কেঁপে উঠলো। চোখ খুলতে না খুলতেই দেখলো বর্ণা দৌড় দিয়েছে। দিব্য দৌড় দিয়ে ওকে ধরতে পারলো না। ওর মনে হল মেয়েটার মাথা পুরোই নষ্ট হয়ে গেছে।

বাড়ি ফিরেই শোনে মামা-বাড়ি যাওয়া বন্ধ। বাবা ওকে আর ওর মাকে নিয়ে শহরে যাবে, ঢাকা শহরে। ঢাকা শহরের কথা ও কত্ত শুনেছে কিন্তু নিজে চোখে কখনো দেখেনি। ঢাকার কথা ভাবতেই বর্ণার পাগলামির কথাটা ভুলে গেল। ঢাকার চিড়িয়াখানা, জাদুঘর আর বড় বড় দালানের কথা ভেবে ভেবে রাতে ওর ঘুমই এলো না। খুব ভোর বেলাতেই ওরা ঢাকা রওনা দিলো আর পৌঁছলো রাতের বেলা। বাবার এক বন্ধুর বাসাতে এসে রাতে খেয়েই ঘুম।

কয়েকদিন বাদেই ওরা আলাদা বাসায় উঠলো। জায়গাটার নাম হাজারীবাগ। বাবা ওকে কাছেরই একটা ইশকুলে ভর্তি করিয়ে দিলো। নতুন ইশকুল, নতুন বন্ধু পেয়ে দিব্য পুরোনো সব ভুলে গেল। কোন কোন দিন বিকেলে বেলাতে আবহানী মাঠে খেলা দেখতে যায়, কখনো কখনো খেলেও; কোন কোন দিন রাস্তায় ঘুরে ঘুরে নতুন নতুন রাস্তা চেনে। এই শহরের মাঝেও একটা খালের মতন পেল, লোকে ওটাকে ধানমন্ডি লেক বলে। লেকের ধারে একটা বকুল গাছ আছে। ওর নীচে দাঁড়িয়ে বকুলের গন্ধ শুঁকলেই বর্ণার কথা মনে পড়ে যায়। ভাবে ওকে বলে আসতে পারলে খুব ভালো হত।

দিনকে দিন দিব্যর সমস্যাটা প্রকট থেকে প্রকটতর হয়ে উঠছে। ওর শুধু বর্ণার কথাই ভাবতে ভালো লাগে। বর্ণার ঠোঁটের ছোঁয়া পাবার কথা ভাবতেই শিহরিত হয়ে ওঠে। বর্ণাকে দেখবার জন্য মনটা ছটফট করে ওঠে কিন্তু ওর বাবার চকের নতুন ব্যবস্যা শুধু চলছেই না, রীতিমত দৌড়াচ্ছে। তাই আর ওদেরকে বাড়ি নিয়ে যাবার সময় তার হয়ে ওঠে না। দিব্য ছটফট করে আর পড়াশোনার মাঝে ডুব দিয়ে নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করে।

দেখতে দেখতে চারটে বছর পার হয়ে গেলো। এসএসসি আর এইচএসসি দু'টোতেই ভালো ফল করেছে, কত নতুন বন্ধু-বান্ধবী হয়েছে; কিন্তু বর্ণাকে আর ভুলতে পারে নি। ও মনে মনে বুঝতে পারে ওর এই গভীর অনুভূতির নাম ভালোবাসা। ও বর্ণাকে ভালোবাসে, অনেক ভালোবাসে। আগামীকাল ওরা বাড়িতে যাবে। এতদিন বাদে বর্ণা, দিয়াকে দেখবে, অন্য বন্ধুদেরকে দেখবে ভাবতেই ভালো লাগছে। তাই আজ সকালে ধানমন্ডি লেকের ধারের বকুলতলা থেকে অনেকগুলো বকুল কুড়িয়েছে। সেই ফুল দিয়ে গেঁথেছে মালা। কাল বর্ণাকে ঐ মালাটা পড়িয়ে দেবে।

ভোরবেলা রওনা হয়ে বাড়ি পৌঁছতে রাত হয়ে গেল। রাতে খেয়ে-দেয়েই বিছানায় গেল। বর্ণার মুখখানি ভাবতে ভাবতেই ঘুমিয়ে গেল। সকাল হতেই ইশকুলের দিকে ছুটলো। যেতে যেতে ওর মাথায় আসলো, এখন তো আরা কেউ ইশকুলে পড়ে না! তাই বর্ণার বাড়িতে গেল। কিন্তু ওখানে গিয়ে দেখলো বর্ণারা কেউ নেই, ও বাড়িতে নতুন কেউ থাকে। ওর মাথায় যেন বাজ ভেঙে পড়লো। নিজেকে সামলে নিয়ে দিয়াদের বাড়িতে গেল। দিয়া ওকে নিয়ে এল ঐ পুরোনো ভাঙা মন্দিরের পুকুর পাড়ে। দিয়া দিব্যকে মনটাকে শক্ত করতে বললো। দিব্য বললো, 'কেন? কী হয়েছে? আমার বর্ণার কী হয়েছে?' দিয়া চুপ থাকায় ও চিৎকার করে বলে, 'বর্ণার কী হয়েছে? ওর কি বিয়ে হয়ে গেছে?' দিয়া বললো, 'বর্ণা যে তোকে ভালোবাসতো আমি তা জানি। ও চলে যাবার আগে আমাকে সব বলে গিয়েছে। ও তোকে অনেক দেখতে চেয়েছে কিন্ত তোদের ঢাকার ঠিকানা কেউ দিতে পারলো না। অনেক কষ্ট নিয়ে বর্ণা এক কঠিন অসুখে বর্ণা মারা গেছে...... ...... ......' দিব্য প্রচণ্ড জোরে চিৎকার করে উঠলো কিন্তু গলা দিয়ে কোন শব্দ হল না। দিব্য ওর হাতের বকুল ফুলের মালাটা পুকুরের জলে ভাসিয়ে দিলো।

গন্ধে ভরা বকুল-মালা
থাকবে তোমার গলে...
গলায় তারে ঠাঁই দিলে না,
তুমি গেলে চলে...
ঐ আকাশের তারা হয়ে
আছো কি মোর পাশে?
পুকুর পাড়ে তোমায় খুঁজি
বকুল ফুলের বাসে...