মঙ্গলবার, ১২ জুন, ২০১২

বকুল ফুলের মালা


পৌনে চারটে বাজে। মাত্র পৌনে দু'ঘণ্টাতেই দিব্যর ভাত-ঘুমটা ভেঙে গেল। মেজাজটা খিঁচড়ে আছে। কফির জন্য জল গরম দিয়ে ফ্রেশ হতে গেল। ফ্রেশ হয়ে ফিরে কড়া একটা ব্ল্যাক কফি নিয়ে বসলো। কফিতে আর চুমুক দেওয়া হয় না। কফির পোড়া গন্ধে নাকটা একটু ডুবিয়েই বাইরের দিকে চোখ দেয়। আকাশে অনেক মেঘ। বিষণ্ণ আকাশ দেখে দিব্যর মনটাও বিষণ্ণ হয়ে ওঠে। আকাশের দিকে তাকিয়ে আগের কথা মনে পড়ে যায়। বুকটা হু হু করে ওঠে, আর চোখের কোণাটা ভেজা কিনা তা আর আঁধার ঘরে বোঝা যায় না।

সদরপুরের শৈশব। শৈশবের ভালোবাসা। ভালোবাসার বর্ণা। আট কেলাশে পড়া অবস্থায় মাত্রই একটু-আধটু বুঝতে শিখেছে বন্ধুত্ব কী ব্যাপার। তবে কেলাশের মেয়েরা যে কী সব বলে আর নিজেরা নিজেরাই হাসাহাসি করে তা ওরা ছেলেরা অনেকেই বুঝে উঠতে পারে না। তারপরও কেলাশের বর্ণা আর দিয়ার সাথে ওর খুব ভালো বন্ধুত্ব হয়ে গেছে। রোজ বাড়ি ফেরার পথে বেশ খানিকটা পথ একসাথেই হেঁটে আসতে হয়। ফিরতে ফিরতে এক পুরোনো ভাঙা মন্দিরের পুকুর পাড়ে বসে গল্প করে। কোন কোন দিন দিয়া না থাকলে দিব্য আর বর্ণা পুকুরের সিঁড়িতে বসে পা ডুবিয়ে রাখে। অপর পারের বকুল গাছ থেকে ঝরে পড়া ফুলগুলো ভেসে আসে ওদের পায়ের সামনে। মাঝে মাঝেই বর্ণাটা দিব্যর দিকে তাকিয়ে থাকে, কিছু একটা বোঝাতে চায় কিন্তু দিব্য কিছুই বুঝে উঠতে পারে না।

এভাবেই কেটে যাচ্ছিলো সুখের দিনগুলো। আর দিনকে দিন বর্ণা একটু বেপরোয়া হয়ে উঠছিল দিব্যকে কিছু একটা বোঝানোর জন্য কিন্তু বুদ্ধু দিব্য কি আর তা বোঝে! দেখতে দেখতে গরমে নাভিশ্বাস ওঠার দিন চলে এলো। অবশ্য আগামীকাল থেকেই গ্রীষ্মের ছুটি। তাই ওদের সাথে বেশ কিছুদিন দেখা হবে না বলে দিব্যর মনটা খারাপ ছিলো। আজ আবার দিয়া আসে নি। দিব্য আর বর্ণা চুপচাপ ফিরছে। দু'জনেই কথা বলতে গিয়েও কিছু বলছে না। দিব্য বলতে চাইছিলো যে এই ছুটির দিনে মামার বাড়ি যাবে সে কথা আর বর্ণা দিব্যকে বলতে চাইছিলো মনের গভীর এক অনুভূতির কথা। দু'জনেই ভাঙা মন্দিরটার পুকুর পাড়ের সিঁড়িতে গিয়ে বসলো। বর্ণা কিছু একটা বলতে চাইলো অনেকবার কিন্তু পারলো না। না বলতে পেরে ও দিব্যকে বললো, 'তুই একটু চোখ বোজ তো!' কিন্তু কেন?', দিব্য জিজ্ঞাস করলো। কিন্তু বর্ণা এর উত্তর না দিয়ে আবারো বললো, 'যা বললাম তা একটু করই না!' দিব্য চোখ বোজার কিছুক্ষণ বাদে ওর গালে বর্ণার নরম ঠোঁটের আলতো ছোঁয়া টের পেল। কিছু না বুঝতেই ও একটু কেঁপে উঠলো। চোখ খুলতে না খুলতেই দেখলো বর্ণা দৌড় দিয়েছে। দিব্য দৌড় দিয়ে ওকে ধরতে পারলো না। ওর মনে হল মেয়েটার মাথা পুরোই নষ্ট হয়ে গেছে।

বাড়ি ফিরেই শোনে মামা-বাড়ি যাওয়া বন্ধ। বাবা ওকে আর ওর মাকে নিয়ে শহরে যাবে, ঢাকা শহরে। ঢাকা শহরের কথা ও কত্ত শুনেছে কিন্তু নিজে চোখে কখনো দেখেনি। ঢাকার কথা ভাবতেই বর্ণার পাগলামির কথাটা ভুলে গেল। ঢাকার চিড়িয়াখানা, জাদুঘর আর বড় বড় দালানের কথা ভেবে ভেবে রাতে ওর ঘুমই এলো না। খুব ভোর বেলাতেই ওরা ঢাকা রওনা দিলো আর পৌঁছলো রাতের বেলা। বাবার এক বন্ধুর বাসাতে এসে রাতে খেয়েই ঘুম।

কয়েকদিন বাদেই ওরা আলাদা বাসায় উঠলো। জায়গাটার নাম হাজারীবাগ। বাবা ওকে কাছেরই একটা ইশকুলে ভর্তি করিয়ে দিলো। নতুন ইশকুল, নতুন বন্ধু পেয়ে দিব্য পুরোনো সব ভুলে গেল। কোন কোন দিন বিকেলে বেলাতে আবহানী মাঠে খেলা দেখতে যায়, কখনো কখনো খেলেও; কোন কোন দিন রাস্তায় ঘুরে ঘুরে নতুন নতুন রাস্তা চেনে। এই শহরের মাঝেও একটা খালের মতন পেল, লোকে ওটাকে ধানমন্ডি লেক বলে। লেকের ধারে একটা বকুল গাছ আছে। ওর নীচে দাঁড়িয়ে বকুলের গন্ধ শুঁকলেই বর্ণার কথা মনে পড়ে যায়। ভাবে ওকে বলে আসতে পারলে খুব ভালো হত।

দিনকে দিন দিব্যর সমস্যাটা প্রকট থেকে প্রকটতর হয়ে উঠছে। ওর শুধু বর্ণার কথাই ভাবতে ভালো লাগে। বর্ণার ঠোঁটের ছোঁয়া পাবার কথা ভাবতেই শিহরিত হয়ে ওঠে। বর্ণাকে দেখবার জন্য মনটা ছটফট করে ওঠে কিন্তু ওর বাবার চকের নতুন ব্যবস্যা শুধু চলছেই না, রীতিমত দৌড়াচ্ছে। তাই আর ওদেরকে বাড়ি নিয়ে যাবার সময় তার হয়ে ওঠে না। দিব্য ছটফট করে আর পড়াশোনার মাঝে ডুব দিয়ে নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করে।

দেখতে দেখতে চারটে বছর পার হয়ে গেলো। এসএসসি আর এইচএসসি দু'টোতেই ভালো ফল করেছে, কত নতুন বন্ধু-বান্ধবী হয়েছে; কিন্তু বর্ণাকে আর ভুলতে পারে নি। ও মনে মনে বুঝতে পারে ওর এই গভীর অনুভূতির নাম ভালোবাসা। ও বর্ণাকে ভালোবাসে, অনেক ভালোবাসে। আগামীকাল ওরা বাড়িতে যাবে। এতদিন বাদে বর্ণা, দিয়াকে দেখবে, অন্য বন্ধুদেরকে দেখবে ভাবতেই ভালো লাগছে। তাই আজ সকালে ধানমন্ডি লেকের ধারের বকুলতলা থেকে অনেকগুলো বকুল কুড়িয়েছে। সেই ফুল দিয়ে গেঁথেছে মালা। কাল বর্ণাকে ঐ মালাটা পড়িয়ে দেবে।

ভোরবেলা রওনা হয়ে বাড়ি পৌঁছতে রাত হয়ে গেল। রাতে খেয়ে-দেয়েই বিছানায় গেল। বর্ণার মুখখানি ভাবতে ভাবতেই ঘুমিয়ে গেল। সকাল হতেই ইশকুলের দিকে ছুটলো। যেতে যেতে ওর মাথায় আসলো, এখন তো আরা কেউ ইশকুলে পড়ে না! তাই বর্ণার বাড়িতে গেল। কিন্তু ওখানে গিয়ে দেখলো বর্ণারা কেউ নেই, ও বাড়িতে নতুন কেউ থাকে। ওর মাথায় যেন বাজ ভেঙে পড়লো। নিজেকে সামলে নিয়ে দিয়াদের বাড়িতে গেল। দিয়া ওকে নিয়ে এল ঐ পুরোনো ভাঙা মন্দিরের পুকুর পাড়ে। দিয়া দিব্যকে মনটাকে শক্ত করতে বললো। দিব্য বললো, 'কেন? কী হয়েছে? আমার বর্ণার কী হয়েছে?' দিয়া চুপ থাকায় ও চিৎকার করে বলে, 'বর্ণার কী হয়েছে? ওর কি বিয়ে হয়ে গেছে?' দিয়া বললো, 'বর্ণা যে তোকে ভালোবাসতো আমি তা জানি। ও চলে যাবার আগে আমাকে সব বলে গিয়েছে। ও তোকে অনেক দেখতে চেয়েছে কিন্ত তোদের ঢাকার ঠিকানা কেউ দিতে পারলো না। অনেক কষ্ট নিয়ে বর্ণা এক কঠিন অসুখে বর্ণা মারা গেছে...... ...... ......' দিব্য প্রচণ্ড জোরে চিৎকার করে উঠলো কিন্তু গলা দিয়ে কোন শব্দ হল না। দিব্য ওর হাতের বকুল ফুলের মালাটা পুকুরের জলে ভাসিয়ে দিলো।

গন্ধে ভরা বকুল-মালা
থাকবে তোমার গলে...
গলায় তারে ঠাঁই দিলে না,
তুমি গেলে চলে...
ঐ আকাশের তারা হয়ে
আছো কি মোর পাশে?
পুকুর পাড়ে তোমায় খুঁজি
বকুল ফুলের বাসে...


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন