সোমবার, ৬ আগস্ট, ২০১২

বন্ধু...

কথা নয় মুখে মুখে,
কথা হবে মনে মনে।
দূরে- কাছে যত বন্ধু আছে,
কথা হবে তোমার সনে...
‍‍‍[জেমসের গান 'কথা হবে']

এই পোস্টটা আমার দূরে-কাছে যত বন্ধু আছে, যারা একদিন বন্ধু ছিল, যারা একদিন বন্ধু হবে তাদের সবাইকে উৎসর্গ করলাম।




বন্ধু, রহো রহো সাথে
আজি এ সঘন শ্রাবণপাতে।
ছিলে কি মোর স্বপনে সাথিহারা রাতে?
বন্ধু, বেলা বৃথা যায় রে
আজি এ বাদলে আকুল হাওয়ায় রে --
কথা কও মোর হৃদয়ে, হাত রাখো হাতে।
[রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর]


বন্ধুত্ব দিবস নিয়ে মাথা ব্যথা নেই কিন্তু বন্ধু নিয়ে আছে। বন্ধুর সাথে সম্পর্ক, চির সবুজ বন্ধুত্ব, কোন একটা নির্দিষ্ট দিনের ধরা-বাঁধা কিছু নয়। বন্ধুত্ব প্রতি দিনের, বন্ধুত্ব চির সবুজ, বন্ধুত্ব অবিচ্ছেদ্য। আমি গা ভাসাই আর না ভাসাই কর্পোরেটের কল্যাণে, উৎসব উদযাপনের ইচ্ছেয়, উপহার-কার্ড-ফুল বিক্রির জোয়ারে অনেকেই গা ভাসায়, আর সে স্রোতের কিছুটা আমাকেও ছুঁয়ে যায়।

প্রতি বছরের আগস্টের প্রথম রবিবারটা আমার জন্য বিশেষ কিছুই ছিলো না, শৈশবে-কৈশরে কখনো এই নিয়ে ভাবিও নি ভালো করে। কৈশরের শেষভাগে এসে প্রাণের জোয়ারে, প্রেমের জোয়ারে বুঝতে হয়েছে এই বিশেষ দিবসের বিশেষত্ব। সেই থেকে কেন যেন এই দিনটা নানাভাবে আমার মনে দাগ কেটে গেছে। কখনো ভালো কিছু স্মৃতি, কখনো দুঃসহ বেদনা দাগ কেটে গেছে। এই বিশেষ দিনটাতেই ভালোবাসার মানুষটাকে অন্য বন্ধুদের সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলাম, বন্ধুত্বের জোয়রে সবাই একসাথে ভাসতে চেয়েছিলাম। আবার কয়েক বছর বাদে ঠিক এই বিশেষ দিনেই পেয়েছি সবচেয়ে বিশ্বস্ত মানুষের কাছ থেকে অবিশ্বাসের দুর্বিসহ যন্ত্রণা, সুন্দর একটা সম্পর্ক ভেঙে যাবার আগমনী বার্তা। আবার গেল বছর আমার পাথর হৃদয়ে ঘাস ফুল ফোঁটাতে এসেছিল একজন, সাথে ছিল বন্ধুত্বের ডালাঃ 'প্রতিদিন বন্ধুত্বের দিন', ভার্চুয়াল থেকে রিয়েল হবার আমন্ত্রণ। সে হৃদয়ে ঢুকেছে, হৃদয়ে থেকেছে, আবার ঐ হৃদয়কেই ভেঙেচূড়ে বিদায় নিয়েছে সময়েরই স্রোতে।

বন্ধুত্ব কী তা বোঝার আগেই বন্ধু পেয়েছি। আমার বয়স যখন মোটে পাঁচ, তখন পড়তে গিয়েছিলাম একটা স্কুলে। বাবা-মায়ের উদ্দেশ্য ছিল মূল স্কুলে ভর্তি হবার আগেই স্কুল জীবনের বিভিন্ন ব্যাপার সম্পর্কে ধারণা লাভ করা। সেখানে একটা ছেলে ছিল যে রোজ আমার সাথে বসতো। ওর চেহারা মনে নেই, নামটাও মনে নেই। শুধু মনে আছে ও আমাকে দোস্ত ছাড়া আর কিছু বলতো না, একসাথে বসতাম, এক আরেক-জনের সাথে বাটার বন কিংবা রিং চিপস্‌ শেয়ার করতাম।

প্রথম সরকারি স্কুলের বিশেষ কারো কথা আমার মনে নেই, শুধু মনে আছে চলে যাওয়াদের দেশে হারিয়ে যাওয়া আমার চিরবন্ধু দিদিমার কথা। দিদিমাই আমাকে প্রতিদিন আনা-নেওয়া করতো। সেই দিদিমার সাথে কত দুষ্টুমি করতাম। স্কুল শেষে পালিয়ে থেকে দিদিমাকে কাঁদাতাম, পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে মুখের হাসি ফিরিয়ে আনতাম, ফিরবার পথে গল্প শুনতাম, রাতে ঘুমোনোর আগে গল্প শুনতাম। আরেকটা ছেলের কথা আবছা মনে পড়ে যার সাথে টিফিন ব্রেকে স্কুলের ভাঙা গাড়িতে উঠে গাড়ি চালানো খেলা খেলতাম, পালা করে হতাম ড্রাইভার-হেল্পার।

দ্বিতীয় সরকারি স্কুলের প্রথম দিনেই বাবা ক্লাশে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল এক ছেলের সাথে, ওকে সবাই ভুট্টুমামা নামে ডাকতো। স্কুলের প্রথম দিনেই শেষ ক্লাশের আগেই পালিয়ে ছিলাম। স্কুলের একমাত্র ফুল বাগানে দু'জনে মিলে ফুল ছিঁড়ছিলাম আর ধরা খেয়েছিলাম নিজের বাবার কাছে। সেই কান মলুনির কথা আজও ভুলি নি। এই স্কুলেই পেয়েছি কাছের বন্ধুদের। স্কুলের ক্লাশ রুম, বরফ-পানি খেলার সিন্ডিকেট নেতা হওয়া, তিনজনে মিলে কোন একটা অঙ্কের সমাধান দাঁড় করানো, মুরগি-দৈত্য-প্রিজমের মতন সাথী পাওয়া, কিংবা নেতা ফরহাদ, কাপ্তান রোমেল, মাঠের বলদ, চোরা মারুফ, ট্যাং বাবা মকি, লাজুক রাহাত, পর্ন ব্যবসায়ী বেজী, ক্লাশ পালানো, আগ্রণীর পুকুরে আড্ডা, আজিমপুরে স্যারের বাসায় প্রেমের জাগরণ, কিংবা উদয়নে এসে আড্ডা, টাংকি মারা - কোন কিছুই কখনো মুছে যাবে না এই মন থেকে। চির সবুজ বন্ধুত্ব, চির দিনকার বন্ধুত্ব আর তার স্মৃতি।

প্রথম কলেজে অনেক নতুন মানুষ দেখলাম, দ্বিতীয় কলেজেও তাই। অনেক অনেক মানূষ দেখেছি, কথা বলেছি কিন্তু আপন করে পেয়েছিন হাতে গুণে ২-৪ জন। রিম্মি-স্নিগ্ধা-সৌরভ এর সাথে দোস্তিটা একটু বেশিই গাঢ় ছিল, কারণ ওরাই ছিল আমার প্রেমের সহায়ক! প্রেমের কারণে কলেজ পর্যন্ত বদলেছিলাম। তাই হারিয়ে ছিলাম অনেককেই। তবে আশা নামের এক মিষ্টি বন্ধুর কথা ভোলা সম্ভব না, পারবোও না কখনো।

প্রথম বিশ্ববিদ্যালয়ের দিন মানেই শুধুই খেলার মাঠ। জাহাঙ্গীর নগরের খেলার মাঠটা সত্যিই দারুন ছিলো। সাথে ছিলো শীতের পাখি দেখা, টঙ্‌ ঘরের সিঙাড়া-চা, বড় ভাইয়াদের র‍্যাগিং প্রচেষ্টা। ওখানে কারো সাথে বন্ধুত্ব না হলেও ৩ টা ছেলে আর একটা পাগলী মেয়ের সাথে কিছুটা সখ্যতা হয়েছিল। দ্বিতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে আসতে আসতে অনেকেই অনেক এগিয়ে গেছে তাই তাল মেলাতে পারছিলাম না। অনেকটা সময় পরে এসে একঝাঁক ছেলে-মেয়েকে পেয়েছিলাম অনেক আপন করে। আইরিনা, নিশিন্দা, মাহি, সুমিত, কৃতী, লিজা, শাকিল, তপু, শাহেদ, নীল, এরিক, পিঙ্কি, আরমান, প্রিয়ম, নাবিলা, রিফাতসহ আরো অনেকে। তবে তপু আর শাহেদের মতন এত ভালো ছেলে আমি খুব কমই দেখেছি।

সময়ের সাথে সাথে কত বন্ধু হারিয়ে গেলো, কত নতুন এলো, তবে কিছু নাম থাকে চির অম্লান। কখনো কখনো মনে হয়েছে আমি বুঝি সত্যিই খুব একা, ওরকম সময়ে একাকিত্বকে ঘুঁচিয়ে দিতেই নতুন কাউকে পেয়ে গেছি। এই ব্লগটাই এক পরম বন্ধু। এই ব্লগ জগত থেকেও কেউ কেউ হয়ে গেছে অনেক বেশি আপন। অনলাইন জগতেই তৃণা, নাবিলা, দ্রোহ, রানা, পার্থ, পাপীর মতন ভাই-বোন-বন্ধু পেয়েছি। আবার এই সময়েরই মাঝে কেউ ডুব মেরেছে, কোথায় জানি না, আর কেউ তার স্বরূপ চিনিয়েছে নতুন করে, অদ্ভুত সাজে। এরই সাথে বনিতার মতন এক বন্ধু পেয়েছি যাকে আপন ভাবা যায়, যার সাথে প্রাণখুলে কথা বলা যায়।

মাঝে মাঝে বন্ধুদের ওপর অনেক অভিমান হয়। মনে হয় জেমসের মতন করে গেয়ে উঠিঃ

যেদিন বন্ধু চলে যাবো, চলে যাবো বহুদূরে...
ক্ষমা করে দিয়ো আমায়,ক্ষমা করে দিয়ো...
মনে রেখো কেবল একজন ছিলো
যে ভালোবাসতো শুধুই তোমাদের...
চোরা সুরের টানেরে বন্ধু মনে যদি ওঠে গান,
গানে গানে রেখো মনে, ভুলে যেয়ো অভিমান...
মনে রেখো কেবল একজন ছিলো
যে ভালোবাসতো শুধুই তোমাদের...
ভরা নদীর বাঁকেরে বন্ধু ঢেউয়ে ঢেউয়ে দোলে প্রাণ,
চলে যেতে হবে ভেবে কেঁদে ওঠে মন প্রাণ...


মনে গেঁথে থাকা নামগুলোর ভেতর অনেকেরই নাম নিলাম শুধু একজনের নাম নিলাম না। নিবো না। ও এগিয়ে চলুক তার নতুন জীবনে, জীবনটাকে রাঙাক নতুন করে নতুন মানুষের সাথে। ও যা করার করেছে, যা হবার হয়েছে। ওর দোষগুলো মাফ করে দিলাম, আর ও যেন আমার দোষগুলোকে মাফ করে দেয়। আর বলবো, ও যেন ভালো থাকে।

অনেক কথাই বলে ফেললাম। শেষটা করছি একটা কবিতা দিয়ে। কবিতাটার আগে দূরে-কাছের সব বন্ধুদের জানাই উষ্ণ শুভেচ্ছা। কারো মনে কোন কষ্ট দিয়ে থাকলে মাফ করে দিয়ো। হয়তো কষ্ট দিয়েছি, তবে মনে রেখো এই আমি শুধু ভালোবাসতেই চেয়েছিলাম, হয়তো পারি নি।


বন্ধুত্ব

মনের সাথে মনেরই মিল, প্রাণের সাথে প্রাণ।
বুকের মাঝে আয়রে সখা, আয় ধরি সে গান।
ছোট্টবেলা নদীর ধারে, জলের মাঝে পা দুলিয়ে
গান জুড়োতাম গলা ছেড়ে।সময়টা দেয় সব ভুলিয়ে।
ভুলিনি যে সেসব কথা, কত কথা তোমার-আমার।
বুঝিনি তো দোস্তিটা কী! গুরুত্ব কী ছিলো তোমার!
ঝড়ের রাতে আম কুঁড়োতাম মজিদ মিয়ার বাগে,
ফিরলে বাড়ি কান মলুনি দিতেন যে মা রাগে।
সন্ধ্যা বেলা জ্বরের ঘোরে কেঁপে কেঁপে মরি,
চুরি করে এনে দিতে জ্বর তাড়ানোর বড়ি।
পড়লে ধরা, জ্যাঠামশায় দিলেন তোমায় কত্তো মার।
মার খেয়েছো, দুষ্টুমিটা মানে নি তো একটুও হার।
আজকে যখন একলা থাকি মনটা তো খুব কাঁদে
তোমার থেকে অনেক দূরে জীবনেরই ফাঁদে।
ভাবি নানান কাজের মাঝে লিখবো চিঠি তোমায়ঃ
বন্ধু, তুমি কেমন আছো?? মনে আছে আমায়??
আজকে বুঝি দোস্তিটা কী, আর তুমি কী ছিলে।
যতই থাকো দূরে তুমি, আছো আমার দিলে।

আগস্ট, ২০১০
দেবাশিস্‌ মুখার্জি

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন