শনিবার, ১১ ফেব্রুয়ারী, ২০১২

বাঙালির দেউলিয়াত্ব


একটু-আধটু কবিতা নিয়ে এখনো ব্লগে টিকে আছি। মন থেকে কোন লেখা আসে না। স্মৃতিকাতরতার কাব্যে ডুবি। ঐ আমার জীবন। আজ বিশেষ কারণেই মনের মাঝে বিস্ফোরণ হল। ক্ষোভটাকে ভাষা দিতে চাইছি। জানি না পারবো কি না।


বাঙালি রাজনীতি, ভাষা, সংস্কৃতিতে অন্যন্য এক জাতি। বাঙালির গৌরব তো আর কম দিনের না। কোলকাতাকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছিল আধুনিক বাঙালির জাতীয়তা বোধ। যা ছড়িয়ে ছিল পুরো বাংলা জুড়েই। বাঙালির পায়ের ওপর ভর করেই বাতাস পেত ভারতের স্বাধিকার লড়াই। কিন্তু বাঙালি শেষতক তার সফল হয় নি। ধর্মকে পুঁজি করে নোংড়া খেলায় মেতে উঠেছিল জিন্নাহ সাব। আর সেই ঘোলা পানিতে মাছ শিকার করে গেল নেহেরু সাব। লাভ হল ইংরেজদের, আর ধরা খেল বাঙালি। বাংলা ভাগ হয়ে গেল। সংস্কৃতি আর ভাষাও বদলে যেতে লাগলো। ওপারে চললো বাংলার হিন্দুয়ানী আর হিন্দিয়ানী, আর এপারে চললো মুসলমানী।

আমরা ব্লগ সহ বিভিন্ন জায়গায় ওপারের বাঙালিদের গাল দেই। ওদের দোষ ওরা দিনে দিনে বাঙালিত্ব হারিয়ে ভারতীয় হয়ে উঠছে। হিন্দিকে প্রাণের ভাষা হিসেবে মেনে নিয়েছে। যার প্রমাণ মেলে ওদের টেলিভিশন চ্যানেলগুলোতে যেগুলো মূলত বাংলা চ্যানেল হওয়া সত্ত্বেও ধীরে ধীরে হিন্দিকে জায়গা করে দেওয়া হচ্ছে। বাংলা কথোপকথনের মাঝে ‘ক্যায়া বাত হ্যায়’ ধরণের হিন্দি জুড়ে দেওয়া হয়। টালিগঞ্জের বাংলা চলচ্চিত্রে হিন্দি গান ঢোকানো হয়। কিন্তু আমি এতে ওদের দোষ দেখছি না। আমাদের দেশের দিকে তাকালেই ব্যাপারটা পরিষ্কার হয়ে যাবে। আমাদের দেষের পাহাড়িরা যখন কর্মক্ষেত্রে যান কিংবা আমাদের দেশের কোন টিভি অনুষ্ঠানে কথা বলেন তখন কি তাদের নিজস্ব ভাষায় বলেন নাকি বাংলায় বলেন?? পাহাড়িরা ধীরে বাঙালিদের সাথে মিশে যাচ্ছে। সিলটীরা দিনকে দিন বাঙালি হয়ে উঠছে। তেমনি ওপারের বাঙালরা দিনকে দিন ভারতীয় উঠছে। কোন দোষ নেই। এটাই জাতীয়তার আধুনিক রূপ।

আমরা বাংলাদেশি বাঙালি। আমরা বাঙালির মূল প্রবাহের ঝাণ্ডাবাহক। আমরা তো আর ভারতে থাকি না। তবে আমরা কেন আমাদের বাঙালিত্বের দেউলিয়াত্ব প্রকাশ করছি?? আমরা কেন হিন্দির দিকে ঝুঁকছি?? আমাদের মহিলারা কেন ‘কাসুটি জিন্দেগি’ ধরণের টিভি ধারাবাহিকে আসক্ত হচ্ছে?? আমাদের মায়েরা কেন তাদের শিশুদের হিন্দি কার্টুন ‘ডোরেমন’ দেখিয়ে ভাত খাওয়ায়??

গেল বছর মুম্বাই এর শাহরুখ এসেছিল ঢাকাতে। তখন টাকা-পয়সা খরচের ব্যাপারটা নিয়ে আমি পোস্ট দিয়েছিলাম। সেখানে কেউ কেউ এমন দাবি করেছিল যে আমাদের টাকা আছে তাই আমরা ওকে এনে বাঁদড় নাচিয়েছি। কতিপয় মানুষের হাস্যকর দাবিতে টাকার প্রসঙ্গটা বাদ দেই। কিন্তু আমাদের দর্শকেরা কেন স্টেজে গিয়ে হিন্দি বললো। কিংবা আমাদের মন্ত্রী কেন শাহরুখের নাচ দেখার টিকিট না পেয়ে মাটিতে বসেই বাঁদড় নাচ দেখে??

আমাদের তো গোল্ডফিশ মেমোরি। তাই এদেশের নামে জিকির তুলি, আর পরক্ষণেই ভুলে যাই। আমিও হয়তো সবার মতন ভুলতে বসেছিলাম। গত কয়েক দিনের দু’টো ঘটনা গোল্ডফিশ হতে দিলো না।

(১)

কিছুদিন আগেই আমার এক বন্ধুর বিয়ে গেল। টাকা-পয়সা খরচ করে জোড় আয়োজন করা হয়েছিল বলেই মনে হয়। আমি অসুস্থ্য ছিলাম বলে আমার আর যাওয়া হয় নি। কিন্তু হলুদের অনুষ্ঠানের রিহার্সেলে যাওয়া হয়েছিল। আয়োজনটা সাজানো হয়েছে গোটা বিশেক হিন্দি গান দিয়ে। এটা আমাদের দেশে খুবই সাধারণ দৃশ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে।

বিয়ের অনুষ্ঠানে ছেলে-পেলেরা একটু মজা করবেই। কিন্তু সেগুলো করার জন্য কি আমাদের দেশে কোন গান নাই?? আর আমাদের কি মুম্বাই চলচ্চিত্রের অনুকরণেই কোমর দোলাতে হবে??

(২)

গতকাল নানা ব্যস্ততায় বিপিএল এর উদ্বোধনী অনুষ্ঠান দেখা হয় নি। আজকে ওটার পুনর্প্রচার দেখতে বসেছিলাম। ওখানে কেন ভারতীয় শিল্পীদের ডেকে আনা হল তা আমার বোধগম্য হল না। আমাদের দেশে কি ভালো সঙ্গীত শিল্পী নেই?? আর মালাইকা-বিপাশাদের নিয়ে শরীর সর্বস্ব নাচের আয়োজন কেন করতে হবে??

আমি একের পর এক প্রশ্ন করেই যাচ্ছি। কারো পক্ষেই হয়তো এর পেছনে একটা কারণ বাদে যৌক্তিক কিছু তুলে ধরা সম্ভব হবে না। কারণটা হল বাঙালি দিনকে দিন দেউলিয়া হয়ে যাচ্ছে। সেদিন হয়তো আর খুব বেশিদিন দূরে না যেদিন ভারতীয় হিন্দি আগ্রাসন আমাদেরকে পুরোই গিলবে।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন