বৃহস্পতিবার, ৩০ সেপ্টেম্বর, ২০১০

বাবরি-মসজিদ না রাম-মন্দির??


ভারতীয় মহাদেশের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার অন্যতম একটা কারণ হল এই বাবরি মসজিদ অথবা রাম মন্দির।এটি ভারতের উত্তরপ্রদেশ রাজ্যের ফাইজাবাদ শহরের অতি প্রাচীণ শহর অযোধ্যার রামকোট পাহাড়ের ধারে অবস্থিত।মুসলমানদের দাবী এটা তাদের জায়গা।অন্যদিকে হিন্দুদের দাবি এটা তাদের অবতার রামের পূণ্যজন্মস্থান।তাই এই জায়গার একমাত্র দাবিদার তারাই।

এবার একটু ইতিহাসের দিকে চোখ বুলানো যাক।আমরা ইতিহাসে দেখতে পাই মুঘল-সম্রাট বাবুর ১৫২৭ খ্রিষ্টাব্দে এইস্থানের মন্দির ভেঙ্গে একটা মসজিদ নির্মাণ করেন।১৯৪০ এর আগে এই মসজিদের নাম ছিলো ‘মসজিদ-ই-জন্মস্থান’।অর্থাৎ মসজিদের নামটিও রামের জন্মভূমির সাক্ষী হয়ে ছিলো।

হিন্দুদের দাবি অনুসারে, বাবুর ১৫২৭ খ্রিষ্টাব্দে আফগান থেকে এসে চিত্তরগড় এর রাজপুত রানা সংগ্রাম সিংকে পরাজিত করে এবং অযোধ্যার পবিত্রভূমিতে মন্দির ভেঙ্গে এই মসজিদ নির্মাণ করান।১৯৯২ সালে যখন হিন্দুমৌলবাদীরা মসজিদটিকে ভাঙ্গার চেষ্টা করে তখন বেশ কিছু পাথরের শিলালিপি পাওয়া যায় যাতে ‘দেবনাগরি লিপি’ তে লেখা সংস্কৃত শ্লোক পাওয়া যায়।

জৈনদের দাবি অনুসারে, অষ্টাদশ শতাব্দিতে জৈন সন্ন্যাসীরা এখানে এই মন্দির স্থাপন করেন।তাদের মতে ষোড়শ শতাব্দিতে এখানে মূলত জ়ৈন এবং বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের উপাসনালয় ছিলো।

এইস্থানের দাবি নিয়ে বেশ কয়েকবারই সংঘর্ষের সৃষ্টি হয়।এখানে একই স্থাপনায় হিন্দু-মুসলমানেরা একইসাথে নিজনিজ প্রার্থণা করতো।কিন্তু সমস্যার সূত্রপাত ঘটে ১৮৫৩ তে যখন নির্মোহী সঙ্ঘ এর একছত্র মালিকানা দাবি করে বসে।কিন্তু ১৮৫৭ এর সীপাহি বিপ্লবে হিন্দু-মুসলমানদের মধ্যে অবিশ্বাসের জন্মনেয় আর মুসলমানেরা মসজিদ প্রাঙ্গনে হিন্দুদের প্রবেশে বাধা দেয়।

১৯৪৯ এর এক রাতে হিন্দুরা মসজিদের ভেতরে রাম-সীতার মূর্তি শাপন করে।আদালত নির্দেশ দেয় এই মূর্তি সরিয়ে নেয়ার জন্য কিন্তু তা আর বাস্তবায়ন হয় নি।১৯৮৫ তে হিন্দুমৌলবাদীরা এর দখল নিতে চাইলে রাজীব গান্ধী প্রশাসনের দৃঢ়তায় ব্যর্থ হয়।

১৯৯০ সালে বাংলাদেশে এরশাদের সরকার বাবরি মসজিদ ভাঙ্গার গুজব রটিয়ে দাঙ্গার সূচনা করে।ঢাকা সহ বিভিন্ন স্থানে নিরীহ অসহায় হিন্দুদের উপর আক্রমণ চালায় এরশাদের পোষা গুণ্ডা আর মৌলবাদীরা।এর চাক্ষুষ সাক্ষী আমি নিজেও।ওই বয়সেই আমাকে দেখতে হয় আগুনের লেলিহান শিখা। লোকজন গোপীবাগে আমাদের বাসার পিছনের ঋষিপাড়ায় আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দেয়।পরিবারে সবাইকে প্রাণ বাঁচিয়ে অন্যত্র আশ্রয় নিতে হয়।

৬ ডিসেম্বর, ১৯৯২ তে তারা আর ব্যর্থ হয় না।তারা আক্রমণ করে এই মসজিদের কিছু অংশ ভেঙ্গে ফেলতে সক্ষম হয়।এর ফলস্বরূপ ভারতব্যাপী সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় প্রায় ২০০০ লোক প্রাণ হারায়।এদের মধ্যে মুসলমানদের সংখ্যাই বেশি।এই দাঙ্গার হুজুগে বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গায় হিন্দুদের উপর আক্রমণ চালায় মৌলবাদী মুসলমানেরা।

                     চিত্রঃ প্রত্নতত্ত্ব বিশারদদের বিশ্লেষণ
ভারত সরকার এই ঘটনার তদন্তের জন্য ১৬ ডিসেম্বর, ১৯৯২ এক তদন্ত কমিশন(Liberhan Commission) গঠন করে।কমিশন দীর্ঘ ১৭ বছর পরে ৩০ জুন,২০০৯ প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং এর নিকট দাখিল করে।এই রিপোর্টে কয়েকজন হিন্দু সাংসদের সংশ্লিষ্টতা খুঁজে পাওয়া যায়।এদের মধ্যে উত্তর প্রদেশের মূখ্যমন্ত্রী কল্যান সিং,সাবেক প্রধান মন্ত্রী অটল বিহারী বাজপেয়ী, লালকৃষ্ণ আদভানী আর মুরালী জোশীর মত High Profile নেতাদের নামও ছিল।যদিও পুরো রিপোর্ট এখনও প্রকাশ করা হয় নি।

অনেক দিন ধরেই এই স্থাপনার দাবিদার নির্ধারণ নিয়ে আদালতে মামলা ঝুলছিলো প্রায় ৬০ বছর ধরে।।প্রথম মামলা হয় ১৯৪৯ সালে।পরবর্তীতে ১৯৫৯ ও ১৯৬১ সালেও দু'টি মামলা হয়েছিলো।আজ দীর্ঘ ৬০ বছর পর বহুপ্রতিক্ষীত এই মামলার রায় ঘোষণা করেন এলাহাবাদ উচ্চাদালত।তারা এই রায়ের সঠিকতা নিশ্চত করার জন্য নৃতত্ত্ব বশারদের সাহায্য নেন।ভারতীয় প্রত্নতত্ত্ব বিশারদদের বিশ্লেষণ অনুযায়ী এই জায়গাটায় আসলে বহুপ্রাচীণ মন্দিরের ধ্বংশাবশেষ। 

এলাহাবাদ উচ্চ আদালতের লক্ষ্ণৌ বেঞ্চের বিচারপতিত্রয় সিবাগত উল্লাহ খান, সুধীর আগারয়াল ও ধর্মবীর শর্মা ঘোষণা দেন যে আসলে ২.৭৭ একর জায়গাটির প্রকৃত দাবিদার হিন্দুরাই।সম্রাট বাবুর মদির ভেঙ্গে মসজিদ নির্মাণ করেননি।তিনি মন্দিরের পাশেই মসজিদ নির্মাণ করেছিলেন।তবে শান্তি বজায় রাখার জন্য এই জায়গাটিকে তিন অংশে বিভক্ত করে এক-তৃতীয়াংশ মুসলমানদের সুন্নি ওয়াক্‌ফ বোর্ড, এক-তৃতীয়াংশ নির্মোহী আখড়া এবং বাকি এক-তৃতীয়াংশ হিন্দুদেরকে হিন্দু মহাসভাকে দিতে বলেন।মন্দিরের বাইরের জমি পাবে সুন্নি ওয়াক্‌ফ বোর্ড।ঐজায়গা থেকে রামে-সীতার মূর্তি সড়ানো যাবে না।সীতারাসাইয়া মন্দিরের মালিক হবে নির্মোহী আখড়া।আগামী তিনমাসে এই ভাগাভাগি কার্যকর করা হবে।ততদিন পর্যন্ত ঐজমিতে স্থিতাবস্থা বিরাজ করবে।তবে ৯০ দিনের মধ্যে আপিল করা যাবে।মামলার দুপক্ষই আপিল করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

রায়ে হয়তো সত্যেরই জয় হয়েছে।কিন্তু শান্তির উদ্দেশ্যে যে ভাগাভাগি তা হয়তো কোন নতুন অশান্তির সূচনা ঘটাতে পারে।ভারতে অনেক মন্দির-মসজিদ আছে।তাই যদি এই জায়গাটা মন্দির কিংবা মসজিদে না দিয়ে এখানে কোন হাসপাতাল কিংবা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্থাপন করা হোত তবে বেশি ভালো হতে বলেই আমি মনে করি।

তথ্যসূত্রঃ http://en.wikipedia.org/
      http://news.bbc.co.uk/2/hi/south_asia/2528025.stm
      http://expressbuzz.com/
      http://dailykalerkantho.com/?view=details&type=gold&data=Laptop&pub_no=298&cat_id=1&menu_id=13&news_type_id=1&index=0

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন