শনিবার, ২১ জুলাই, ২০১২

হুমায়ূন আহমেদ আর কিছু কথা...


উৎসর্গঃ
যারা হুমায়ূন এর ভক্ত এবং যারা হুমায়ূনের উপর বিরক্ত!

হুমায়ূন আহমেদ, বাংলাদেশের একটি জনপ্রিয় নাম, ১৯ জুলাই, ২০১২ দেহ ত্যাগ করলেন। যাকে নিয়ে চলছে মৃত্যু পরবর্তী আলোচনা-সমালোচনা, কান্নার বাঁধভাঙা ঢেউ, আদিখ্যেতা, ছেলেমানুষী, পণ্য কেনা-বেচাসহ আরো অনেক কিছুই। সেসব নিয়েই আজকের এই আলোচনা।

আলু পত্রিকার সেলিনা হোসেনের কথাকে তুলে ধরে বলেছেঃ



প্রথম আলোর এই রিপোর্ট দেখে একদলা থু ছাড়া মুখে চলে আসে। ওরা এখন মৃত হুমায়ূনকে নিয়ে ব্যবসায় ব্যস্ত। বাঙালি জাতি উঠে এসেছে একটা যুদ্ধের মধ্য দিয়ে, ত্রিশ কিংবা তারও অধিক মানুষের রক্তের নদীর মাঝ দিয়ে, চোখের সামনে দেখে এসেছে রাজাকার-আল বদর-আল শামস কী করে এসেছে। তাই  রাজাকারকে ঘৃণা করাটা কাউকে শিখিয়ে দিতে হয় না, এটা বাঙালির স্বভাবজাত বৈশিষ্ট্যের মাঝেই পড়ে। রাজাকারকে রাজাকার বলবার জন্য কোন নব্য সাহস লাগে না, এটা একটা স্বতস্ফূর্ত ব্যাপার। হুমায়ূন আহমেদ কাছ থেকে সাহস ধার না নিয়েই বাঙালি ১৯৮১ এর জানুয়ারিতে বায়তুল-মোকাররম মসজিদ প্রাঙ্গণে গোলাম আযমকে রাজাকার বলে গাল দিয়েছে, জুতাপেটা করেছে।



একথা শুরুতেই স্বীকার করে নিয়েছি হুমায়ূন আহমেদ বাংলাদেশের জনপ্রিয়তম ব্যক্তি। আমি উনার ওপর যতই বিরক্ত হই না কেন আমার ওপরও উনার প্রভাব আছে, কিছুটা হলেও। ছোটবেলায় উনার নাটকের একনিষ্ঠ ভক্ত ছিলাম। বহুব্রীহির কথা মনে নেই। যা এখনো মনে আছে তা হলঃ অয়োময়, কোথাও কেউ নেই, আজ রবিবার, নক্ষত্রের রাত সহ আরও অনেক। তার চলচ্চিত্র দেখেছি। শঙ্খনীল কারাগার, আগুনের পরশমণি, দুই-দুয়ারী, শ্রাবণ মেঘের দিন - এগুলো বাংলাদেশের ভালো চলচ্চিত্রের উদাহরণ না বললে মিথ্যে বলা হবে। তার হাত দিয়ে গ্রাম-গঞ্জের গান, হাসন রাজার গান, বারী সিদ্দিকীর গান নতুন করে প্রাণ পেয়েছে।

উনার যে মানুষকে ধরে রাখবার একটা আকর্ষণীয় ক্ষমতা আছে তার প্রমাণ 'কোথাও কেউ নেই' নাটক। এটি বাংলাদেশের একমাত্র নাটক, সারা বিশ্বের ক্ষেত্রেও হতে পারে, যার জন্য মানুষ রাস্তায় নেমেছে। নাটকে বাকের ভাই এর ফাঁসি বাতিল করবার জন্য এই দেশের মানুষ রাস্তায় মিছিল-মিটিং-বিক্ষোভ করেছে, বোদি নাটকে বাকের ভাই এর বিরুদ্ধে মিথ্যে সাক্ষী দেবার জন্য রাস্তায় মার খেয়েছে।

উনি আমাদের জন্য অনেক শিক্ষণীয় কিছুও রেখে গেছেন। উনার কাছ থেকেই আসে গাছের প্রয়োজনীয়তার গুরুত্বের কথা, চোখ দান করবার প্রয়োজনীয়তার কথা, জাটকা না ধরে ইলিশকে বাঁচানোর কথা, ওর স্যালাইন এর কথা, সেনিটারি ল্যাট্রিন এর কথা, সবুজ ছাতা হাসপাতালের কথা। আরো অনেক কিছুই এসেছে যা ঠিক মুহূর্তে মনে আসছে না।

হুমায়ূন আহমেদ হিমু লিখেছেন, মিসির আলী লিখেছেন। লোকে গোগ্রাসে এগুলোই গেলে। আর আমি বলি উনাকে ডুবিয়েছেই এই দু'টো চরিত্র। লোকে বলে হিমু মানুষকে দর্শন শিখিয়েছে আর মিসির আলী লজিক! হিমু মানুষকে শিখিয়েছে খালি পায়ে হাঁটার কথা, মানূষকে বিভ্রান্ত করবার কথা, মহা পুরুষ হবার নাটকীয় প্রচেষ্টার কথা। এই দর্শণ আমাদের সমাজের জন্য ক্ষতিকর ছাড়া আর কিছু না। আর মিসির আলীতে যদি ঠিকমত লজিক থাকে তবে বলতে হয় আমার লজিক জ্ঞানই শূন্য। হয়তো মানুষের কাটতির কারণেই তিনি বছরের পর বছর একই বছরে কয়েকটা করে হিমু, মিসির আলীর জন্ম দিয়ে গেছেন। সেই একঘেঁয়ে, গৎবাঁধা জিনিসই লোকে গিলে খেয়েছে। তাই উনার মানের অবনয়নের জন্য পাঠকও কম দায়ী নয়। পাঠক যদি উনার দায়সারা লেখাই গোগ্রাসে গিলে যান, তবে উনি তাই লিখে যাবেন বছরে অনেকগুলো করে। উনি তো টাকার দিকে তাকাবেনই কারণ তার পেশাটাই লেখালেখি। তবে একটা কথা ভুলে গেলে তো চলবে না কেউ যখন সংখ্যা বাড়িয়ে দিবেন, তখন তার মান কমে যাবেই। এটা শুধু হুমায়ূন আহমাদের জন্য প্রযোজ্য না, সকলের জন্য প্রযোজ্য, আমার ব্লগের ব্লগারদের জন্যো প্রযোজ্য। উনার এইসব লেখা সময় কাটানোর জন্য আদর্শ, বিশেষ করে আমি যখন বাস কিংবা ট্রেনে কোথাও যাচ্ছি। কিন্তু যখন এইসব লেখাগুলোকেই ভালো সাহিত্য বলে ভোট দিতে হয় তখনই প্রশ্ন চলে আসে পাঠকের মান নিয়ে। আর যে সাহিত্যে পাঠকের মান ভালো না, সে সাহিত্যের মান কমবেই।

হুমায়ূন আহমেদের যে মেধা আর মনন ছিলো তা আমাদের জন্য একটা বিশাল সম্পদ হতে পারতো। কিন্তু তিনি তা না করে একটা সময়ে অন্য পথে হাঁটতে শুরু করেছিলেন। যে সময়ে উনার লেখার মান কমে যাচ্ছিলো (অবশ্যই অত্যধিক লেখার কারণে) সে সময়েই পাঠকের কিংবা তার নিজেরই উচিত ছিল রাশ টেনে ধরা। উনি তো তা করেনই নি উল্টো শেষের দিকে এসে নিজেকে করেছেন বিতর্কিত। দেয়াল নামের বিতর্ক তার আগের ভালোকিছুকে করে দিয়েছে ম্লান। মনে করিয়ে দেয় ব্লগার ধ্রুবতারার মাসি কাব্য পোস্টের কথা!

অনেকেই উনার ব্যক্তিগত জীবনকে টেনে এনে উনার নিন্দা করেন। এটা খুবই গর্হীত কাজ। যারা করে আমি তাদেরকে ধ্বিক্কার জানাই। আমার আলোচনার বিষয় হওয়া উচিত ব্যক্তি হুমায়ূন না, হুমায়ূনের সৃষ্টি।

অনেকেই হুমায়ূন আহমেদের 'জোসনা ও জননীর গল্প' গল্প প্রসঙ্গে হুমায়ূনকে আক্রমণ করে যেটা খুব একটা ঠিক না।এটা নিয়ে অনেক আগে ব্লগে আলোচনা করেছি। তাই আর নতুন করে স্ক্রিন শট দিচ্ছি না। তবে উনার রেফারেন্স ছিল বিচারপতি হাবিবুর রহমান আর কবি শামসুর রাহমান। মজার ব্যাপার হল যেসব লোকের রাগ হুমায়ুনের ওপর তারা বাকি দু'জনের ব্যাপারে নীরব থাকেন। ঐ বিচারপতিই হন মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের বিভিন্ন আলোচনা অনুষ্ঠানের সভাপতি, আর শামসুর রাহমান আসন করে রাখেন 'স্বাধীনতা তুমি' কবিতা দিয়ে।

তবে দেওয়াল নিয়ে চরম বিরক্ত। শুধু তার উপরেই বিরক্ত না তাদের উপরও বিরক্ত যারা নানা অজুহাতে হুমায়ূনকে এই দেওয়াল লজ্জা থেকে বাঁচাতে চান এই বলে মাত্র দু'টো অধ্যায় পড়েই কোন সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত না। যা বোঝার ঐ দুই অধ্যায়েই বোঝা হয়ে গেছে। বাকি অধ্যায়গুলোতে বঙ্গবন্ধু কিংবা তার সহযোদ্ধাদের কথা যতটাই সঠিকভাবে তুলে ধরুক না কেন খুনী ফারুককে যেভাবে তুলে ধরেছেন তাইই যথেষ্ট হুমায়ূনের পুর্বের ভালো কাজকে ধূলিসাৎ করে দিতে। কেউ কেউ প্রশ্ন তুলেছেন হয়তো অনিচ্ছায় করেছেন, সত্যিটা আর জানা যাবে না। তাদের উদ্দেশ্যে বলি সত্যি প্রকাশ করবার মত সাহস না থাকলে চুপ থাকা উচিত, তবু মিথ্যাচার করা উচিত না। হুমায়ূন আহমেদ যা করেছেন তা স্পষ্টতই ইতিহাস বিকৃতি। আর আমাদের ইতিহাসকে যে বা যারা বিকৃত করে, কিংবা করবার চেষ্টা করে তাদের প্রতি আমার কোনই সহানুভূতি নাই।


উনার প্রতি সহানুভূতি নাই তবে উনাকে নিয়ে ব্যবসার প্রতিবাদ জানাই, তীব্রভাবেই জানাই। মৃত হুমায়ূন আহমেদকে নিয়ে টেলিভিশন মিডিয়া যে বাণিজ্যের শুরু ঘটালো তার প্রতি ধিক্কার জানাই। টেলিভিশনের আলোচনায় যারা টেলিভিশন মাতিয়ে রাখছেন তাদের সকলেরই কি মন খারাপ?? কেউ কেউ তো তাদের সবগুলো দাঁত মিডিয়াতে দেখিয়ে দিলেন। একি শোকের প্রকাশ?? আর তারা হুমায়ূন আহমেদ মারা যাবার আধ ঘণ্টার মাঝেই কীভাবে এসে পৌঁছলেন?? কেউ কেউ বেশ সাজ-গোজ করেই এসেছেন। তারা কি আগে থেকেই তৈরি হয়ে ছিলেন?? চ্যানেল আই রাত ১১ টা ৪০ মিনিটে প্রচার করলো হুমায়ূন আহমেদ আর নেই, ১১ টা ৪৫ এ হুমায়ূণ মৃত্যুতে ডিজিটাল ব্যানার নিয়ে হাজির। ওরা কি আগেই তৈরি হয়ে ছিল?? এরা মৃত্যুকেই করেছে পণ্য।

এবার হুমায়ূন আহমেদ প্রসঙ্গ ছেড়ে অন্য একটা প্রসঙ্গে আসি। সেলিনা হোসেনের বিবৃতিকে অস্ত্র করে প্রথম আলো আমাদের দেশের রাজাকার বিরোধী মনোভাবকে নিয়ে ব্যাঙ্গ করেছে। কোন প্রগতিশীল শক্তি ঘাতকদালাল নির্মূল কমিটিকে নিয়ে ব্যাঙ্গ করে না, তবে ইনকিলাবসহ কিছু রাজাকার পক্ষেরর শক্তি এক সময়ে ব্যাঙ্গ করে একে বলতো 'ঘাদানিক', প্রথম আলোও সেই দলে যোগদান করে তাদের অবস্থানটা আমাদের কাছে আরও পরিষ্কার করে দিয়েছে। সব কিছুর নাম সংক্ষিপ্ত করতে হয়না, বদলে দেবার জোয়ারে সুবহে সাদিক সেটা ভুলে গেছে। আমরাও একটু যোগ দেই তার সাথে। প্রথম আলোর মতিউর রহমান এর নাম সংক্ষিপ্ত হলে হয় মর। এবার এর সাথ একটা আকার যোগ দেই, কারণ গ্রাম দেশে কোন কোন লোককে লোকে ব্যাঙ্গার্থে নাম বিকৃত করে 'আ' যোগ করে দেয়, যেমনঃ হরিপদকে ডাকে হরিপদা, কামালকে ডাকে কামাইল্লা ইত্যাদি। এভাবে মতিউর রহমানের নাম হয় মরা।

আজকে সবাইকে একটা অনুরোধ করে যাচ্ছিঃ
আজ থেকে প্রথম আলোর মতিউর রহমানকে মরা বলে ডাকা শুরু করুন!!


চিত্রউৎসঃ সচলায়তন

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন